কক্সবাজার, রোববার, ৫ মে ২০২৪

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী, উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের অবসান ঘটিয়ে পৃথিবীর মানচিত্রে স্থান করে নেয় এক টুকরো বাংলাদেশ। সোনার বাংলাদেশ গঠনের দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে বঙ্গবন্ধুর হাত ধরে শুরু হয়েছিল উন্নয়নের অগ্রযাত্রা। যা নানা প্রতিকূলতা পেরিয়ে এখনো চলমান। পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ নামে আখ্যায়িত বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে আজ উন্নয়নশীল রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিতি অর্জন করেছে।

আজ বিশ্বজুড়ে জয়জয়কার, পালিত হচ্ছে স্বাধীনতার সূবর্ণজয়ন্তী। এই ৫০ বছরে আমরা কী পেরেছি বাংলাকে সোনার বাংলায় রূপ দিতে? পেরেছি কী ছন্দযোগ করতে? বিভিন্ন খাতের বর্তমান অবস্থান পর্যালোচনা করলে সহজেই মিলবে এসব প্রশ্নর উত্তর।

কৃষিখাত  

বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। যেখানে কৃষিই তার প্রধান চালিকাশক্তি। ১৯৭২ সালে দেশের প্রথম বাজেটে বঙ্গবন্ধু কৃষি বিপ্লবের কথা বলে কৃষি উন্নয়ন খাতে বাজেট দিয়েছিলেন ১০১ কোটি টাকা। বর্তমানে ২০২১-২২ অর্থবছরে কৃষি ও পল্লি উন্নয়নের খাতের জন্য বাজেট ধরা হয়েছে ৭৪ হাজার ১০২ কোটি টাকা।

২০১৬-১৭ সালের শ্রম জরিপ অনুযায়ী, শ্রমশক্তির ৪০.৬২ শতাংশ এখনো কৃষিতে নিয়োজিত, অর্থাৎ কৃষি এখনো বিনিয়োগের বড় ক্ষেত্র। অথচ ১৯৭২ সালে দেশের মোট আবাদি ভূমি যা ছিল স্বাধীনতার ৫০ বছরে তা ৩০ শতাংশ কমে দাড়িয়েছে ৮৫.৭৭ লাখ হেক্টর এবং এর মূল কারণ কৃষি জমিতে অপরিকল্পিত স্থাপনা।

কৃষিখাতে ব্যাপক উন্নতি সাধনের পরেও আমরা এখনও আমদানি নির্ভরতা কাটিয়ে উঠতে পারছি না। এর কারণ হিসেবে আমরা দেখি কৃষি জমির পরিমাণ হ্রাস, দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি, বিভিন্ন প্রাকৃতিক দূর্যোগ, কৃষি ব্যবস্থায় উন্নত প্রযুক্তির অপ্রতুলতা। যদিও এসকল সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য বর্তমান সরকার একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পের মতো বেশ কিছু প্রকল্প হাতে নিয়েছে।

এছাড়াও কৃষকদের মাঝে বিনামূল্যে বীজ বিতরণ, সরকারি-বেসরকারি ও কৃষি ব্যাংক হতে কৃষকদের মাঝে ঋণ প্রদান, কৃষি গবেষণায় বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং কৃষি খাতকে সমৃদ্ধ করার লক্ষ্যে বর্তমান তরুণ প্রজন্মের অংশগ্রহণ নিশ্চিতে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। সুতরাং বাংলার কৃষি খাতের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল বলা যেতেই পারে।

মাথাপিছু আয়

একেবারে শুরুর দিকে ১৯৭৩-৭৪ সালে বাংলাদেশের জিডিপির আকার ছিল মাত্র ৭ হাজার ৫৭৫ কোটি টাকা, মাথাপিছু আয় ছিল ১২৯ ডলার এবং দারিদ্রের হার ছিল ৭০%। দরিদ্রের তকমা লাগানো দেশ কতটুকু এগিয়ে গিয়েছে তা আজ ৫০ বছর পরে এসে ২০২০ সালের জরিপের সাথে তুলনা করলে আমরা বুঝতে পারি।

২০১৯-২০ অর্থবছরের জরিপ অনুযায়ী, বর্তমান জিডিপি ২৭ লাখ ৯৬ হাজার কোটি টাকা যা ৩৬৯ গুণ, মাথাপিছু আয় ২০৬৪ ডলার ও দারিদ্রের হার কমে দাড়িয়েছে ২০.৫%। মানবসম্পদ উন্নয়নে সেখানে যোগ্যতা থাকা দরকার ৬৪ স্কোর, বর্তমান বাংলাদেশ সেখানে পেয়েছে ৭৩.২ স্কোর।

এত উন্নতির পরেও দারিদ্রের কারণ হিসেবে দেখাতে পারি, অনুন্নত কৃষি ব্যবস্থা, অনগ্রসর শিল্প ব্যবস্থা, ত্রুটিপূর্ণ শিক্ষা ব্যবস্থা, দারিদ্রের দুষ্টুচক্র, দুর্ভোগের ব্যাপকতা, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, বাস্তবমূখী নীতি ও পরিকল্পনার অভাব। এসব সমস্যা সমাধানে গ্রহণ করা হচ্ছে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে বিভিন্ন পদক্ষেপ। দারিদ্র বিমোচন ফাউন্ডেশন,

, বয়স্ক-বেকার ভাতা প্রদান, আত্মকর্মসংস্থানের জন্য ঋণদান কর্মসূচিসহ আরো নানা পদক্ষেপ। যা থেকে বুঝা যায়, ভবিষ্যতে বাংলাদেশ দারিদ্রমুক্ত বাংলাদেশে পরিণত হবে।

সড়ক ও যোগাযোগ ব্যবস্থা

যোগাযোগ ব্যবস্থায় এসেছে যুগান্তকারী পরিবর্তন হয়েছে নতুন মাত্রার ছন্দযোগ। পুরো বিশ্ব যখন বলেছিল আমরা পদ্মা সেতু নির্মাণ করতে পারব না, আমরা তা করে দেখিয়েছি। এছাড়াও হার্ডিঞ্জ ব্রিজ, তিস্তা রেলওয়ে ব্রিজ পুনর্নির্মাণ, দীর্ঘ ৫৬ বছর পর আবারও মিতালী এক্সপ্রেস চালু, ২০৪০ সালের মধ্যে সমস্ত সড়ককে ৫ ও ৬ লেনের মধ্যে উন্নীতকরণ প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। নির্মাণ করা হচ্ছে বঙ্গবন্ধু টানেল, মেট্রোরেল। তাছাড়া ও আকাশপথ ও নদীপথে সাধিত হয়েছে উন্নয়ন, সুগম হয়েছে যোগাযোগ ব্যবস্থা। এত উন্নয়নের পরেও এড়ানো যাচ্ছে না সড়ক দূর্ঘটনা। প্রতিদিন খবরের কাগজ খুললেই দেখতে পাই, যন্ত্রদানবের তাণ্ডবে অকালে ঝরে পড়ছে অগণিত প্রাণ। তবে কেন এত দুর্ঘটনা? কারণ হিসেবে বলা যায়- অতিরিক্ত গতি, ওভারটেকিং, আইন অমান্য করা, মহাসড়ক নির্মাণে ত্রুটি ও দূর্যোগ ব্যবস্থাপনা, অদক্ষ চালককে লাইসেন্স প্রদান ইত্যদি।

এর থেকে উত্তরণের জন্য আমাদের সম্মিলিত কাজ করে যেতে হবে। যেমন: লাইসেন্স প্রদানে জালিয়াতি রোধ, বেপরোয়া গতি নিয়ন্ত্রণে সর্বোচ্চ গতিসীমা বেঁধে দেওয়া, যাতায়াতের ক্ষেত্রে আইন অমান্য করার সর্বোচ্চ শাস্তি ও জরিমানা নিশ্চিতকরণ, অতিরিক্ত ট্রাফিক পুলিশ নিয়োগ, জেব্রা ক্রসিং ইত্যাদি। আইনের ও ব্যবস্থাপনার যথাযথ প্রয়োগই পারে দুর্ঘটনামুক্ত নিরাপদ সড়ক উপহার দিতে।

শিক্ষাখাত

বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে শিক্ষাক্ষেত্রে যুক্ত হয়েছে নতুন মাত্রা, সাধিত হয়েছে পরিবর্তন। সাফল্যের কথা উঠলেই যে বিষয়গুলো প্রথমেই আসে তা হলো- শিক্ষা কমিশন গঠন, অবৈতনিক ও প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক নিশ্চতকরণ, সকল স্তরের ঝরে পড়ার হার হ্রাস, উপবৃত্তি ও শিক্ষা বীমার কর্মসূচি, বিনামূল্যে বই বিতরণ, জেন্ডার সমতা ইত্যাদি। কিন্তু তারপরেও সীমাবদ্ধতা থেকেই যায়, ফলে বৃদ্ধি পাচ্ছে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা। এর প্রধান কারণ হচ্ছে অপরিকল্পিত উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান, অপ্রতুল বাজেট প্রণয়ন, গুণগত শিক্ষার কমতি ও কারিগরি শিক্ষার অভাব ইত্যাদি।

অতএব ৫০ বছরের সফলতা ও ব্যর্থতা পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাবো যে, এখনো গবেষণাবিহীন শিক্ষাব্যবস্থা থেকে বেরুতে পারিনি। কিন্তু থেমে নেই অগ্রগতি। বর্তমানে স্বাক্ষরতার হার ৭৫.৬০%। যা ১৯৭১ সালে ছিল ১৬৮%।

স্বাস্থ্যখাত

এছাড়াও চিকিৎসাক্ষেত্রে আমাদের অগ্রগতি চোখে পড়ার মতো। বর্তমানে মানুষের গড় আয়ু ৭২.৪ বছর। আমরা গড়তে পেরেছি বিশ্বমানের প্রযুক্তিনির্ভর চিকিৎসা ব্যবস্থা। গড়েছি পোলিওমুক্ত বাংলাদেশ। আমরা কমিয়ে এনেছি নারী ও শিশু মৃত্যুর হার। আজ দেশের মানুষকে মরতে হচ্ছে না বিনা চিকিৎসায়।

তবে চারিদিকে বাংলাদেশের জয়জয়কার, সেখানে আমরা আজও দেখি নারী নির্যাতন, ধর্ষণ, শিশু শ্রমের মতো বিরাট ব্যাধি, যুব সমাজের বিরাট অংশ আজ ও মাদকের অন্ধকার জগতে।

এই সমস্যা সমাধানে আমাদের হাতে হাত রেখে লড়ে যেতে হবে। বাড়াতে হবে দেশপ্রেম। সৃষ্টি করতে অন্যায়ের বিরুদ্ধে জনমত ও প্রতিবাদ। তবেই এই বাংলায় থাকবে না দুর্নীতি, দরিদ্রতা, কুসংস্কার ও নির্যাতন।

আমরা পাবো বঙ্গবন্ধুর দেখা সেই স্বপ্নের ক্ষুধা ও দারিদ্রতামুক্ত বাংলাদেশ। অতএব এটুকু বলতে পারি, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে আমরা পেরেছি সবক্ষেত্রে ছন্দযোগ করতে।

পাঠকের মতামত: