কক্সবাজার, বৃহস্পতিবার, ২ মে ২০২৪

এক জীবন্ত কিংবদন্তির আর্তনাদ কি কারো কর্ণকুহরে প্রবেশ করবে না?

স্টাফ রিপোর্টারঃ
বাংলাদেশে অনেক যোগ্য, দক্ষ, অভিজ্ঞ, জ্ঞানী ও গুনী হাজারো ব্যক্তি রয়েছেন এতে বিন্দুমাত্র সন্দেহের অবকাশ নেই। কিন্তু এতসব গুনাবলীর সাথে যদি সৎ, ত্যাগী ও পরোপকারী গুণাবলী যুক্ত হয় তাহলে তিনি কতটা উঁচু মানের অতিমানব হতে পারেন তা সহজেই অনুমেয়। তিনি আর কেউ নন, তিনি আমাদেরই দিনাজপুর মহারাজা হাই স্কুলের ১৯৬৮ ব্যাচের এসএসসি’র ছাত্র দ্বিজেন্দ্র নাথ ব্যানার্জী।

দ্বিজেন্দ্র নাথ ব্যানার্জী দু’বার বাংলাদেশের সেরা শিক্ষক হিসেবে রাষ্ট্রীয়ভাবে গোল্ড ম্যাডেল প্রাপ্ত। তিনি অর্ধশতেরও অধিক নাটকের নাট্যকার, পরিচালক এবং অভিনেতা। তাঁর সবগুলো নাটকই জাতীয়ভাবে মঞ্চস্থ এবং পুরস্কারপ্রাপ্ত। তিনি শতাধিক গ্রন্হের লেখক। তিনি এমন কতগুলো গ্রন্হ লিখেছেন যা বাংলাদেশেই নয়, বিশ্বের আর কোথায়ও এধরণের গ্রন্হ এযাবৎ আর কেউ লিখেনি। যেমন “পুতিংবরা” তার একটি গ্রন্থ। এই গ্রন্থটি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রতিটি শব্দ “প” বর্ণ দিয়ে লেখা। এই গ্রন্থটি বাংলা একাডেমি প্রকাশ করেছে এবং এটিই এধরনের একমাত্র প্রকাশিত গ্রন্থ। এধরণের এক একটি বর্ণ দিয়ে তিনি বেশ কয়েকটি গ্রন্থ রচনা করেছেন।

তিনি অদ্যাক্ষরে সকল রীতি ও নীতি অনুসরণ করে “অজ্ঞাত বাস” নামক একটি মহাকাব্য রচনা করেছেন, যেটি পৃষ্ঠার দিক থেকে মাইকেল মধুসূদন দত্তের “মেঘনাদ বধ” মহাকাব্যের প্রায় দ্বিগুণ। মহাকাব্যটির মোড়ক উন্মেচন অনুষ্ঠানে বিশ্বের অনেক জ্ঞানী, গুণী, পন্ডিতসহ রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য তার আলোচনায় জ্ঞানগর্ব মন্তব্য প্রকাশ করে বলেছেন, মহাকাব্যটিতে লিখিত জ্ঞানের ও ভাষার গভীরতা কল্পনাতীত ও বিস্ময়কর। আলোচকগণ বলেছেন, বিস্ময়ের দিক থেকে মহাকাব্যটি অচিরেই বিশ্বে এক মহা আলোড়ণ ও তোলপাড় সৃষ্টি করবে।

দ্বিজেন্দ্র নাথ ব্যানার্জীর অসংখ্য ত্যাগের মধ্যে একটি ত্যাগের কথা উল্লেখ না করলেই নয়। তিনি সেসময় রাজশাহী শহরের একটি সরকারি হাই স্কুলের সহকারী শিক্ষক। ক্লাস সেভেনে তার ছেলে ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেও সেই স্কুলেরই পিয়নের ছেলে ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেনি। পিয়নের কাকুতিমিনতিতে দ্বিজেন্দ্রনাথ ব্যানার্জীর কোমল হৃদয় স্পর্শ করলে তিনি প্রধান শিক্ষককে পিয়নের ছেলেকে স্কুলে ভর্তির বিষয়ে অনুরোধ করেন। কিন্তু তার অনুরোধে কোনো লাভ হয়নি। শেষমেশ প্রধান শিক্ষক দ্বিজেন্দ্র নাথকে বলেন, “পিয়নের ছেলের জন্য আপনার যখন এত দরদ তাহলে আপনি আপনার ছেলেকে এখানে ভর্তি না করালে আমি সেই শূন্য সীটে পিয়নের ছেলেকে ভর্তি করে নিব”। শতভাগ পরোপকারী সাদা মনের ত্যাগী দ্বিজেন্দ্র নাথ ব্যানার্জী তার ছেলেকে সরকারি স্কুলে ভর্তি না করিয়ে পিয়নের ছেলেকে তাঁর সন্তানের আসনে ভর্তি করিয়ে দেন এবং নিজের ছেলেকে পিয়নের ছেলে যেই অখ্যাত বেসরকারি স্কুলে পড়তো সেই স্কুলে দ্বিজেন্দ্র নাথ তাঁর নিজের ছেলেকে ভর্তি করিয়ে দেন। এখানেই শেষ নয়, দ্বিজেন্দ্র নাথ সেই পিয়নের বাসায় গিয়ে বিনা টাকায় পিয়নের ছেলেকে নিজপুত্র মনে করে বিনা বেতনে এসএসসি পর্যন্ত পাঠদান করিয়েছিলেন এজন্য যে, প্রধান শিক্ষক যেন মনে করতে না পারেন যে, দ্বিজেন্দ্র নাথ একজন মেধাহীন ছাত্রকে তার স্কুলে ভর্তি করিয়েছেন। আজকালকার যুগে এধরনের মহান, ত্যাগী ও পরোপকারী ব্যক্তি ক’জনা রয়েছেন!

এই মহান ও মহামানবতুল্য মানুষটি ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হিসেবে অবসর গ্রহনের পর অবসরের সকল অর্থ, নিজের ও তার স্ত্রীর সঞ্চয়ের সকল অর্থ, সোনাগহনার বিক্রয়লব্ধ সকল অর্থসহ ধারবাকি করে ১৬ লক্ষ টাকা একত্রিত করে দিনাজপুরের একজনকে সেই ১৬ লক্ষ টাকা প্রদান করেন ৪ শতক জমি ক্রয়ের জন্য। কিন্তু কে জানতো যে, যিনি জমি বিক্রয় করেছেন তিনি একজন প্রতারক ও ভূমিদস্যু! বিষয়টি জানাজানির পর বিক্রেতার কাছে টাকা ফেরতের জন্য অনেক ধর্না ও কাকুতিমিনতি করেছেন কিন্তু ফলাফল শূন্য হওয়ায় দ্বিজেন্দ্রনাথ ব্যানার্জীর স্ত্রী মিনাক্ষ্মী রানী ব্যানার্জী এই শোকে এক প্রত্যুষে আকস্মিকভাবে হার্ট এ্যাটাক করে মারা যান।

দ্বিজেন্দ্র নাথ ব্যানার্জী প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি ও সরকারের কাছে জমির পজেশন অথবা প্রদত্ত অর্থ ফেরতের জন্য কাকুতিমিনতি করে ধর্না দিয়েই চলেছেন। কিন্তু এ যাবৎ এই মহাজ্ঞানী, গুণী, লেখক, নাট্যকার, ছড়াকার, সৎ, ত্যাগী ও পরোপকারী ব্যক্তিটির কান্না কারো কর্ণকুহরে প্রবেশ করছে না, উপরন্তু তাকে দিনাজপুর থেকে পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে তার জীবন নাসের হুমকিতে। থানা ও আদালতে অভিযোগ দায়ের করা সত্বেও এযাবৎ কোনো লাভ হয়নি। কেননা, ভূমিদস্যুর ক্ষমতা ও হাত অনেক লম্বা।

এভাবেই বিশ্বজ্ঞানভান্ডারে সমৃদ্ধ একজন সৎ, আদর্শ, ত্যাগী, পরোপকারী এই মহান ব্যক্তিটি সবার কাছে কাকুতিমিনতি করতে করতেই একদিন তিনিও কি তার স্ত্রীর মতো এই ধরণী হতে চিরতরে ঝড়ে পরবেন?
এটাই কি একজন দেশের দু’বারের সেরা শিক্ষক, মহাজ্ঞানী, সৎ, ত্যাগী ও পরোপকারী ব্যক্তির পাওনা? এই স্বাধীন দেশের প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি ও সরকার কি অসৎ ও ভূমিদস্যুর পক্ষাবলম্বন করে নীরব থাকবেন? বিচারের বাণী কি এভাবেই নিভৃতে কাঁদতে থাকবে?

পাঠকের মতামত: