বিভিন্ন শারীরিক জটিলতা নিয়ে ঢাকার লালমাটিয়ার ১১ নম্বর সড়কের ফুটপাতে পড়েছিলেন মানসিক ভারসাম্যহীন সাত মাসের এক অন্তঃসত্ত্বা।
এই খবর পেয়ে মূমুর্ষূ অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে স্বেচ্ছাসেবী সমাজকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠান চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ার।
উদ্ধারের সময় ওই নারীর মানসিক অবস্থা এমন ছিল যে, নিজের নামও বলতে পারছিলেন না তিনি। তখন উদ্ধারকারীরাই তার নাম দেন ফাতেমা। এর তিনমাস পরই ছেলে সন্তানের জন্ম দেন ফাতেমা। পাশাপাশি চলে তার মানসিক রোগের চিকিৎসা।
ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠেন ফাতেমা। কিন্তু যাওয়ার কোনও জায়গা না থাকায় সন্তানসহ তার স্থান হয় চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ারের আশ্রমে।
উদ্ধারের এক বছর পর সেই ফাতেমার জীবনে লেগেছে নতুন রঙ। ধুমধাম আর নানা আয়োজনে বিয়ে করেছেন তিনি, বর মিরাজ হোসেন চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ারের একজন কর্মী।
মিরাজ
ফাতেমা-মিরাজের বিয়ে উপলক্ষে সেজেছে চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ার ফাউন্ডেশনের ভবন। ছবি: সকাল সন্ধ্যা
মিরাজের বাড়ি ভোলার চরফ্যাশন উপজেলায়। তার বাবা প্রয়াত বজলুর রহমান পাটোয়ারী। দুই বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে সবচেয়ে ছোট মিরাজ সেবক হিসেবে চাকরি করেন ওই প্রতিষ্ঠানে।
শুক্রবার (২৬ জানুয়ারি) দুপুরে রাজধানীর দক্ষিণ পাইকপাড়ায় প্রতিষ্ঠানটির বৃদ্ধাশ্রমে ছিল ফাতেমা ও মিরাজের বিয়ের অনুষ্ঠান। এ উপলক্ষে রঙ-বেরঙের আলোকসজ্জা আর কাগজে সাজানো হয় বৃদ্ধাশ্রমটি।
আশ্রমের ছাদে তৈরি করা হয়েছিল বর-কনের জন্য সুসজ্জিত মঞ্চ, সেখানেই ছিল অতিথিদের খাবারের স্থান।
মূল আয়োজন করে চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ার। তবে এমন বিয়ের খবর শুনে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন দেশ-বিদেশের অসংখ্য মানুষ।
চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ারের প্রতিষ্ঠাতা মিলটন সমাদ্দার বলেন, “বিয়ের আয়োজনে ১৮ লাখ টাকারও বেশি খরচ হয়েছে। বিয়ে উপলক্ষে কেনা হয়েছে একটি গরু ও দুটি খাসি। ছয় শতাধিক অতিথির জন্য খাবারের আয়োজন করা হয়েছিল। ছিল তেহারি, ডিমের কোরমা আর ফিরনি।
“বিয়ে উপলক্ষে নতুন দম্পতিকে উপহার হিসেবে দেওয়া হচ্ছে টিভি, ফ্রিজ, খাট, সোফা, আলমারিসহ সংসারের জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছুই। বিয়েতে কনের জন্য প্রয়োজনীয় সোনার গহনা, প্রসাধনী, শাড়ি, বরের পোশাক সবকিছুই সংস্থার পক্ষ থেকে কেনা হয়েছে।”
বিয়ে
ফাতেমা-মিরাজের বিয়ের স্টেজ সাজাতে ব্যস্ত প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা। ছবি: সকাল সন্ধ্যা
বিয়ের পর এই দম্পতির বাসাভাড়াসহ ছয় মাসের সংসার খরচও দেওয়া হবে বলে জানান তিনি।
ফাতেমাকে স্ত্রী হিসেবে পেয়ে ভীষণ খুশি মো. মিরাজ হোসেন।
তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “উদ্ধারের সময় ফাতেমা পুরোপুরি মানসিক ভারসাম্যহীন ছিল। হোমে আনার পর পাগলামির কারণে কেউ তার কাছে ভিড়তে পারত না। কিন্তু আমি সাহস করে তার কাছে যেতাম, সেবা করতাম। এক পর্যায়ে সে সুস্থ হয়ে ওঠে।”
ধীরে ধীরে ফাতেমা ও মিরাজের মধ্যে এক ধরনের বোঝাপড়া তৈরি হয়। একে অন্যকে পছন্দ করতে শুরু করেন। তারই ধারাবাহিকতায় এই বিয়ের আয়োজন।
ফাতেমার সঙ্গে সারাজীবন কাটাতে চান মিরাজ, সেজন্য সবার দোয়াও চাইলেন তিনি।
নতুন এই জীবনে খুশি ফাতেমাও। তবে মনে কিছুটা কষ্টও আছে। বললেন, “এতদিন ধরে হোমে সবার সঙ্গে আছি। সবাই আমার স্বজনের মতো হয়ে গেছে। তাই সবাইকে ছেড়ে যেতে হবে ভেবেই খুব খারাপ লাগছে।”
যেভাবো হলো বিয়ের আয়োজন
মানসিক ভারসাম্যহীন ফাতেমা সুস্থ হওয়ার পর নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েন। কারণ যাওয়ার মতো কোনও স্থান ছিল না তার।
একদিন মিলটন সমাদ্দার তার বিয়ের বিষয়ে ভাবনা-চিন্তা শুরু করেন।
মিলটন বলেন, “যখন ফাতেমার বিয়ের বিষয়ে আলোচনা শুরু হলো তখন একদিন অনেকটা দুষ্টুমি করেই তার কাছে জানতে চাইলাম, কাউকে পছন্দ করে কি না। তখন সে আমাকে মিরাজের কথা বলে। এরপর আমি বিষয়টি নিয়ে মিরাজের সঙ্গে কথা বলি। জানতে পারি, মিরাজও মনে মনে ফাতেমাকে পছন্দ করে।”
বিষয়টি নিয়ে মিরাজের পরিবারের সঙ্গে কথা বলেন মিলটন। ফাতেমার পুরো ঘটনা তাদের খুলে বলে তবেই বিয়ের প্রস্তাব দেন তিনি।
প্রথমে ভেবেছিলেন, মিরাজের পরিবার রাজি হবে না। কিন্তু সব জেনেও তারা ফাতেমাকে পরিবারের সদস্য করতে রাজি হয়। এরপরই শুরু হয় বিয়ের আয়োজন।
বিয়ে
ফাতেমা আর মিরাজের বিয়েতে ছিল ৬০০ অতিথি আপ্যায়নের ব্যবস্থা। ছবি : সকাল সন্ধ্যা
নতুন সংসার
নিয়ম অনুযায়ী, বিয়ের পর ফাতেমা আর আশ্রমে থাকতে পারবেন না। নতুন এই দম্পতির সংসার কীভাবে চলবে জানতে চাইলে মিলটন জানান, নতুন দম্পতির বাসাভাড়াসহ ছয় মাসের সংসার খরচ দেওয়া হবে তাদের সংস্থার পক্ষ থেকে। এরই মধ্যে কল্যাণপুরে একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নেওয়া হয়েছে।
মিরাজ পাঁচ বছর ধরে চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ারে চাকরি করেন উল্লেখ করে মিলটন বলেন, সুস্থ হয়ে যাওয়ায় ফাতেমার জন্যও চাকরির ব্যবস্থা করা হয়েছে।
দুজন মিলেমিশে সংসার চালাতে পারবেন বলেও প্রত্যাশা করেন চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ারের প্রতিষ্ঠাতা।
শিশু সন্তানের ভবিষ্যৎ
মানসিক ভারসাম্যহীন অবস্থায় জন্ম দেওয়া সন্তানকে সহ্য করতে পারতেন না ফাতেমা। আশ্রমের অন্যরাই শিশুটির দেখাশোনা করতেন। সবাই ভেবেছিল, সুস্থ হলে পরিস্থিতি বদলে যাবে। কিন্তু দেখা গেল, শিশুটিকে নিজের সন্তান বলেই মানতে পারছেন না ফাতেমা। যার ফলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে যে, আট মাস বয়সী শিশুটি আশ্রমেই থাকবে; জানালেন মিলটন।
উদ্ধারের গল্প
২০২৩ সালের জানুয়ারিতে লালমাটিয়ার ১১ নম্বর সড়কের ফুটপাতে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় পড়েছিলেন মানসিক ভারসাম্যহীন ফাতেমা।
এ ঘটনা মিলটনের স্ত্রী মিঠু হালদারকে জানান তার এক বন্ধু। স্ত্রীর কাছ থেকে খবর পেয়ে ফাতেমাকে উদ্ধার করে চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ারে নিয়ে যান মিলটন।
তিনি বলেন, “উদ্ধারের সময় জ্ঞান ছিল না ফাতেমার। পায়ের একটি ক্ষতে পোকা হয়ে গিয়েছিল। মাথাভর্তি জট, নোংরা শরীর। উদ্ধারের পর জানা যায়, মারাত্মক পুষ্টিহীনতা ও রক্ত শূন্যতায় ভুগছে সে। এরপর সৃষ্টিকর্তার কৃপায় আর দীর্ঘদিনের চিকিৎসায় ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠে ফাতেমা।
পাঠকের মতামত: