কক্সবাজার, শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪

ঈদুল আযহার নামাজ, নিয়ত, নিয়ম ও তাকবির

মুসলমানদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব ঈদ। মুসলমানরা প্রতি বছরে দুটি ঈদ উদযাপন করে থাকেন। এই দিনগুলোতে ঈদের নামাজ পড়া ওয়াজিব। অনেকেই হয়তো জানেন না ঈদুল আযহার(Eid al Adha) নামাজ কীভাবে আদায় করতে হয়। ঈদুল আযহার নামাজ অন্যান্য নামাজের মতোই আদায় করতে হয়। এ নামাজে রুকু, সিজদা, তাশাহুদ সবই আছে। ঈদের নামাজ দুই রাকাত। যা আদায় করা ওয়াজিব এবং তা জামাআতে আদায় করতে হয়। শুধু মাত্র অতিরিক্ত ছয় তাকবির দিতে হয়।

ঈদুল আযহার নামাজের নিয়ত, নিয়ম এবং তাকবির-
ঈদুল ফিতরের নামাজের মত ঈদুল আযহার নামাজ দু রাকাত। ছয় তাকবির।

ঈদুল আযহার(Eid al Adha Salah) নামাজের আরবি নিয়তের বাংলা উচ্চারণ: ‘নাওয়াইতু আন উছাল্লিয়া লিল্লাহি তা আলা রাকয়াতাই ছালাতি ঈদিল আযহা মাআ ছিত্তাতি তাকবীরাতি ওয়াজিবুল্লাহি তা আলা ইক্বতাদাইতু বিহাজাল ইমামি মুতাওয়াজ্জিহান ইলা জিহাতিল কাবাতিশ শারীফাতি আল্লাহু আকবার।’

অনেকের ধারণা নামাজের নিয়ত আরবিতে করা জরুরি। এমনটি ঠিক নয়। যে কোনো ভাষাতেই নামাজের নিয়ত করা যায়। নিয়ত মনে মনে করাই যথেষ্ট।

প্রথম রাকাত: আল্লাহ তাআলার উদ্দেশ্যে কিবলামুখী হয়ে ঈদুল আযহার দুই রাকাত ওয়াজিব নামাজ ৬ তাকবিরের সঙ্গে এই ইমামে পিছনে আদায় করছি বলে নিয়ত বাঁধতে হয়।

প্রথমেই- তাকবিরে তাহরিমা- ‘আল্লাহু আকবার’ বলে নিয়ত বাঁধবেন। ইমাম ও মুসল্লিরা নিয়ত বাঁধার পর ছানা অর্থাৎ এ দোয়াটি পড়বে-

উচ্চারণ: সুবহানাকা আল্লাহুম্মা ওয়া বিহামদিকা ওয়া তাবারাকাসমুকা ওয়া তাআলা ঝাদ্দুকা ওয়া লা ইলাহা গাইরুক। তারপর ইমামের উচ্চস্বরে তাকবির বলার সঙ্গে সঙ্গে মুসল্লিরাও তাকবির বলবেন। প্রথম ও দ্বিতীয় তাকবির বলার সময় উভয় হাত কান বরাবর ওঠিয়ে ছেড়ে দিবেন।

তৃতীয় তাকবিরের সময় উভয় হাত কান বরাবর ওঠিয়ে না ছেড়ে হাত বাঁধবেন। এরপর ইমাম সাহেব সূরা ফাতিহা এবং অন্য সুরা মিলিয়ে রুকু, সিজদা করবেন; মুসল্লিরাও ইমামের সঙ্গ রুকু সিজদা করবেন।

দ্বিতীয় রাকাত: ইমাম সাহেব দ্বিতীয় রাকাতে সূরা ফাতিহা ও অন্য সূরা মিলানোর পর রুকুতে যাওয়ার পূর্বে অতিরিক্ত তিন তাকবির প্রথম রাকাতের মতোই আদায় করবেন। অতপর রুকু-সিজদা করার পর অন্যান্য নামাজের মতোই সালাম ফিরানোর মাধ্যমে নামাজ সম্পন্ন করবেন।

জিলহজ মাসে তাকবির পাঠ :
জিলহজ মাসের ৯ তারিখ ফজরের নামাজের পর থেকে ১৩তারিখ আসর নামাজ পর্যন্ত প্রত্যেক ফরজ নামাজের পর একবার তাকবির পাঠ করা ওয়াজিব।

তাকবিরে তাশরিক
উচ্চারণ : আল্লাহু আকবর, আল্লাহু আকবর, লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবর, আল্লাহু আকবর, ওয়ালিল্লাহিল হামদ্।
অর্থ : আল্লাহ মহান, আল্লাহ মহান; আল্লাহ মহান, আল্লাহ ব্যতিত কোনো উপাস্য নেই; সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য, আল্লাহ মহান।

প্রত্যেক বালিগ পুরুষ-মহিলা, মুকিম-মুসাফির, গ্রামবাসী-শহরবাসী, জামাআতে বা একাকি প্রত্যেক ফরজ নামাজের পর প্রত্যেককে একবার করে তাকবিরে তাশরিক পাঠ করা ওয়াজিব।

ঈদুল আযাহার তাৎপর্য

কোরবানি গুরুত্বপূর্ণ একটি ইবাদত। সামর্থ্যবান ব্যক্তির ওপর কোরবানি ওয়াজিব। ইসলামী শরিয়তের পরিভাষায় কোরবানি বলা হয়- মহান রাব্বুল আলামিনের নৈকট্য ও সন্তুষ্টি লাভের আশায় নির্ধারিত তারিখের মধ্যে হালাল কোনো পশু আল্লাহর নামে জবেহ করা।

কোরবানি নতুন কোনো প্রথা নয় বরং এটা আদিকাল থেকে চলে আসছে। হজরত আদম (আ.) এর যুগে কোরবানির সূচনা হয়েছিল।

আদম (আ.)-এর সন্তান হাবিল-কাবিলের মধ্যে বিবাহ-শাদি নিয়ে যখন মতানৈক্য দেখা দিল, তখন আল্লাহতায়ালা তাদের ইখলাসের সঙ্গে হালাল পশু কোরবানি করার নির্দেশ দিলেন। তিনি বললেন- তোমাদের মধ্যে যার কোরবানি আমার নিকট কবুল হবে তার কাছে মেয়ে বিবাহ দেয়া হবে। হাবিল এবং কাবিল কোরবানির নির্দেশ পেয়ে কোরবানি করল।

হাবিলের কোরবানি আল্লাহর কাছে কবুল হল, কাবিলেরটা হল না। কাবিলের কোরবানি কবুল না হওয়ার কারণে সে ক্ষিপ্ত হয়ে হাবিলকে বলল আমি তোমাকে হত্যা করে ফেলব। এ প্রসঙ্গে আল্লাহতায়ালা এরশাদ করেন- হে নবী আপনি তাদের নিকট যথাযথভাবে আদম (আ.)-এর পুত্রদ্বয়ের কথা আলোচনা করেন, যখন তারা মহান রবের নিকট তাদের কোরবানিকে পেশ করল, তখন একজনের কবুল হল অন্যজনের হল না।

যার কোরবানি কবুল হল না সে ক্ষিপ্ত হয়ে অন্যজনকে বলল আমি তোমাকে খুন তথা হত্যা করে ফেলব। পালনকর্তা একমাত্র মুত্তাকীদের কুরবানি কবুল করেন (সূরা মায়িদা: ২৭)।

কোরবানির গুরুত্ব প্রসঙ্গে মহান রাব্বুল আলামিন কুরআন কারিমে এরশাদ করেন- আমি প্রত্যেক উম্মতের জন্য কোরবানি নির্ধারণ করেছি; যাতে তারা হালাল পশু জবেহ করার সময় আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে (সূরা হজ: ৩৪)। আল্লাহতায়ালা কুরআনে আরও বলেছেন- নিশ্চয়ই আমার নিকট কোরবানির পশুর গোশত ও রক্ত কিছুই কবুল হয় না, তবে আমার নিকট পৌঁছে একমাত্র তাকওয়া (সূরা হজ: ৩৭)।

ঈদুল আযহা( কুরবানি) মানে কি
একদা হজরত যায়েদ ইবনে আরকাম (রা.) রাসুলের (সা.) নিকট জিজ্ঞাসা করলেন, হে আল্লাহর রাসুল (সা.) কোরবানি কী? উত্তরে রাসুলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করলেন- কোরবানি হচ্ছে তোমাদের আদি পিতা হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর জীবনাদর্শ। সাহাবি পুনরায় জিজ্ঞাসা করলেন- কোরবানির ফজিলত কী?

রাসুল (সা.) বললেন, পশুর পশমের পরিবর্তে একেকটি করে নেকি দেয়া হয় (মেশকাত: ১২৯)। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেন, কোরবানির পশুর রক্ত মাটিতে পড়ার আগেই কোরবানিদাতার কোরবানি আল্লাহর দরবারে কবুল হয়ে যায় এবং তার অতীতের সকল গুনাহ মোচন করে দেয়া হয় (তিরমিজি: ১/১৮০)। মহানবী (সা.) আরও এরশাদ করেন, তোমরা মোটাতাজা পশু দেখে কোরবানি কর, কারণ এ পশুই পুলসিরাতের বাহক হবে (মুসলিম: ২৬৩৯)।

কোরবানির দোয়া( ঈদুল আযহার দোয়া)

কোরবানিদাতা নিজের কোরবানির পশু নিজেই জবাই করবেন, যদি তিনি ভালোভাবে জবাই করতে পারেন। কেননা, রাসুলুল্লাহ (স) নিজে জবাই করেছেন। আর পশু কোরবানি করা আল্লাহ তাআলার নৈকট্য অর্জনের একটি মাধ্যম। এই কোরবানির সময় বাঞ্ছনীয় বিষয় হচ্ছে দোয়া পড়া।

কোরবানির পশু জবাইয়ের জন্য প্রস্তুত করে কিবলার দিকে ফিরালে, জবাই করার সময় ও জবাই শেষে বিভিন্ন দোয়া পড়তে হয়। তাহলে ঈদুল আযহার দোয়া পড়ার সুন্নত আদায়ের পাশাপাশি সওয়াবও লাভ হয়।

কোরবানি পশু কিবলার দিকে ফিরিয়ে যে দোয়া পড়বে

وجهت وجهي للذي فطر السموات والأرض حنيفا وما أنا من المشركين، إِنَّ صَلَاتِي وَنُسُكِي وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِي لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ، لَا شَرِيكَ لَهُ ۖ وَبِذَٰلِكَ أُمِرْتُ وَأَنَا أَوَّلُ الْمُسْلِمِينَ، بسم الله الله أكبر.

উচ্চারণ : ইন্নি ওয়াজ জাহতু ওয়াজ হিয়া লিল্লাযি ফাতারাছ ছামাওয়াতি ওয়াল আরদা হানিফাও ওয়ামা আনা মিনাল মুশরিকিন। ইন্না সালাতি ওয়া নুসুকি ওয়া মাহ ইয়ায়া ওয়া মামাতি লিল্লাহি রাব্বিল আলামিন। লা শারিকা লাহু ওয়া বিজালিকা উমিরতু ওয়া আনা মিনাল মুসলিমিন।…বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার।

অর্থ : নিশ্চয়ই আমি দৃঢ়ভাবে সেই মহান সত্তার অভিমুখী হলাম, যিনি আসমান ও জমিন সৃষ্টি করেছেন। আমি মুশরিকদের অন্তর্গত নই। নিশ্চয়ই আমার নামাজ, আমার কোরবানি, আমার জীবন ও আমার মরণ—সবই বিশ্ব প্রতিপালক মহান আল্লাহর জন্য নিবেদিত। তাঁর কোনো শরিক নেই। আমি এ কাজের জন্য আদিষ্ট হয়েছি। আর আমি আত্মসমর্পণকারীদের একজন। আল্লাহর নামে, আল্লাহ সবচেয়ে মহান।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ২৭৮৬; ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৩১২১)

পশু জবেহ করার সময় এই দোয়া পড়বে

اللهم مِنكَ وَلَكَ

আল্লাহুম্মা মিনকা ওয়া লাকা।

অর্থ : হে আল্লাহ, (এই কোরবানির পশু) তোমার পক্ষ থেকে প্রাপ্ত এবং তোমারই জন্য উৎসর্গকৃত।

এরপর بسم الله الله أكبر পড়বে।

উচ্চারণ : বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার

অর্থ : মহান আল্লাহর নামে শুরু করছি। আল্লাহ সবচেয়ে বড়।

জবেহ করার পর এই দোয়া পড়বে

إبراهيم عليه السلام

উচ্চারণ : আল্লাহুম্মা তাকাব্বালহু মিন্নি কামা তাকাব্বালতা মিন হাবিবিকা মুহাম্মাদিন ওয়া খলিলিকা ইবরাহিমা আলাইহিমাস সালাম।’

অর্থ : হে আল্লাহ, এই কোরবানি আমার পক্ষ থেকে কবুল করুন, যেভাবে আপনি তা কবুল করেছিলেন আপনার প্রিয় বন্ধুদ্বয় মুহাম্মদ (সা.) ও ইবরাহিম (আ.)-এর পক্ষ থেকে। (মেশকাত : ১/১২৮)

যদি কেউ একাকি কুরবানি দেয় এবং নিজে জবাই করে তবে বলবে মিন্নি; আর অন্যের কুরবানির পশু জবাই করার সময় ‘মিনকা-মিনকুম’ বলে যারা কুরবানি আদায় করছে তাদের নাম বলা।

ঈদুল আযহার দিনের সুন্নাত :
ঈদুল আযহার সুন্নাতসমূহ যেমন –

ঈদুল আযহার দিনে কিছু না খেয়ে ঈদগাহে যাওয়া সুন্নাত(পশু জবাই না হওয়া পর্যন্ত কিছু না খাওয়া-যিনি কুরবানি দেবেন।

ঈদুল আজহার দিনে ঈদগাহে যাওয়া ও প্রত্যাবর্তনের সময় তাকবির (আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু, ওয়াল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার ওয়া লিল্লাহিল হামদ) উচ্চস্বরে পড়া সুন্নাত।

ঈদুল আজহার নামাজ ঈদুল ফিতর অপেক্ষা অধিক সকালে পড়া সুন্নাত।

ঈদুল আজহার নামাজের পর সক্ষম ব্যক্তির জন্য কুরবানি করা ওয়াজিব।

ঈদুল আজহা বা ঈদুল ফিতরের নামাজের কোনো আযান বা একামত নেই।

ঈদের নামাজ কাযা পড়ার নিয়ম নেই।

ঈদের নামাজ সহীহ হবার জন্য জামা’আতে আদায় করা শর্ত।

ঈদের রাতের (চাঁদ রাত) ফযিলত :

সর্বশ্রেষ্ঠ পয়গম্বর ও সর্বশেষ নবী (সাঃ) বর্ণনা করেন, ‘যে ব্যক্তি ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার রাত্রে জাগরিত থেকে আল্লাহ্ পাকের ইবাদাত বন্দেগীতে মশগুল থাকবে, যে দিন অন্যদের অন্তর মরবে, সে দিন তার অন্তর মরবে না (তাবরানী)’।

বাংলাদেশে ঈদুল আযহা ২০২২ কবে, কত তারিখে
উল্লেখ, প্রতি বছর জিলহজ মাসের ১০ তারিখ ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা ঈদুল আজহা উদযাপন করেন। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশে ২০২২ সালে পবিত্র ঈদুল আযহা অনুষ্ঠিত হবে ১০ জুলাই রোববার।

ঈদুল আযহার ছুটি ২০২২
তবে গত দুই বছরে প্রাণঘাতি মহামারি করোনাভাইরাসের প্রভাবে ঈদ উৎসবে ভাটা পড়েছিল। বিধি-নিষেধ ছুটির বদলে ছিল। কিন্তু এবার পবিত্র ঈদুল আযহার ছুটি আজ বৃহস্পতিবার(৭ জুলাই) থেকে পেতে যাচ্ছেন চাকরিজীবীরা। সরকারি কর্মদিবসের হিসাব অনুযায়ী আজ বৃহস্পতিবার শেষ অফিস। পরের দুই দিন শুক্র ও শনিবার সাপ্তাহিক ছুটি। এরপর ৮ জুলাই থেকে ১১ জুলাই পবিত্র ঈদুল আযহার ছুটি।

পাঠকের মতামত: