কক্সবাজার, রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪

কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের এলএ যেন আলাদিনের চেরাগ

কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের ভূমি অধিগ্রহণ শাখা (এলএ) যেন ঘুষের হাট। সার্ভেয়ারদের সঙ্গে সেখানে প্রকাশ্যে চলে ঘুষ লেনদেনের দেন-দরবার। অধিগ্রহণের ক্ষতিপূরণ পেতে কাগজপত্র শতভাগ ঠিক থাকলেও দিতে হয় মোটা অংকের ঘুষ। জেলা প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট সবার হয়ে এ কমিশনের চেক বা নগদ টাকা গ্রহণ করেন সার্ভেয়ার। পরে চলে ভাগ বাটোয়ারা। এলএ শাখার সার্ভেয়ারদের এমন অপকর্মে ক্ষতিপূরণ নিতে আসা মানুষের হয়রানির শেষ নেই।

শুধু জেলা প্রশাসনের ভূমি অধিগ্রহণ শাখা নয়, এসব সার্ভেয়াররা বাসা ভাড়া নিয়ে সেখানেও এসব দেনদরবারের অফিস খুলে বসেছে। সম্প্রতি এ ধরনের অফিসে পৃথক অভিযান চালিয়ে প্রায় নগদ কোটি টাকা এবং প্রায় ৭ বস্তা জমির মূল্যবান নথিপত্রসহ তিন সার্ভেয়ারকে আটক করেছে র‌্যাব-১৫-এর একটি দল। এ অভিযানে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছেন ভুক্তভোগীরা।

র‌্যাব জানায়, সার্ভেয়ারদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসায় বেশ কিছুদিন ধরে তাদের ওপর নজরদারি বাড়ানো হয়। এ ধারাবাহিকতায় গত বুধবার (১৯ ফেব্রুয়ারি) সার্ভেয়ার ওয়াসিম, সার্ভেয়ার ফরিদ, ও ফেরদৌসের বাসায় অভিযান চালানো হয়। এ সময় বাহারছড়ার ওয়াসিমের বাসা থেকে নগদ প্রায় ৬ লাখ টাকা, ফরিদের বাসা থেকে ৬০ লাখ ৮০ হাজার এবং শহরের তারাবনিয়ার ছড়া এলাকায় সার্ভেয়ার ফেরদৌসের বাসায় অভিযান চালিয়ে আরো প্রায় ২৭ লাখ টাকা জব্দ করা হয়।

র‌্যাব সূত্রে আরও জানা গেছে, এ অভিযানে সার্ভেয়ারদের ঘুষ লেনদেনের হিসাব লিপিবদ্ধ করার কয়েকটি নোট বুকও উদ্ধার করা হয়।

এই নোটবুকের লিপিবদ্ধ থাকা হিসাব মতে, শুধু সার্ভেয়ার ওয়াসিম কয়েক মাসে প্রায় দুই কোটি টাকার কমিশন বাণিজ্য করেছে।

ভুক্তভোগী এক ব্যক্তি জানান, অফিস সময়ে এবং অফিস সময়ের বাইরে সার্ভেয়ারদের ওইসব বাসায় বসে লেনদেন এবং দেনদরবার করতো সার্ভেয়ার ফরিদ এবং ওয়াসিম। অনেকে তাদের বাসা মনে করলেও এটি মূলত অফিসের বাইরে আরেকটি অফিস। এখানে চলতো কমিশন বাণিজ্য।র‌্যাবের অভিযান।তিনি আরও বলেন, কাগজপত্র শতভাগ ঠিকঠাক থাকলেও সার্ভেয়ারদের সঙ্গে কমিশনের কন্ট্রাক্টে না গেলে চেক ইস্যু হয় না। এমনকি চেক ইস্যু হওয়ার আগেই নগদ টাকা এবং চেকের মাধ্যমে ঘুষের টাকা পরিশোধ করতে হয়। আর এই কাজটি সারা হয় দালালের মাধ্যমে।

স্বাভাবিকভাবে শতকরা ১০-১২ শতাংশ কমিশন নেওয়া হলে জটিলতা আছে এমন ফাইলের ক্ষেত্রে কমিশনের হার স্বাভাবিকের চেয়ে তিন-চারগুণও হয়ে যায়।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কমিশনের মোটা অংকের টাকা সার্ভেয়াররা গ্রহণ করলেও এই টাকা যেত জেলা প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর হাতে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে রাজনীতিবিদ, জনপ্রতিনিধিও এই সুবিধাভোগীর তালিকায় রয়েছে।

অভিযানের বিষয়ে র‌্যাব-১৫ এর উইং কমান্ডার আজিম আহমেদ জানান, তিন সার্ভেয়ারকে কমিশনের বিপুল পরিমান টাকা এবং নথিপত্রসহ আটক করা হয়েছে। এদের বিষয়ে আরও অধিকতর তদন্ত চলমান রয়েছে। আমরা আশা করছি, আরও অনেক সত্য বিষয় তদন্তে বেরিয়ে আসবে।

কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন জানান, ইতোমধ্যে অপকর্মের দায়ে কয়েক দফায় ১১ জন সার্ভেয়ারকে প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে। প্রতি সপ্তাহে আমি নিজেই ক্ষতিগ্রস্তদের হাতে চেক তুলে দিচ্ছি এবং জানার চেষ্টা করছি কাউকে কোনো টাকা দেওয়া হয়েছে কিনা।’

তিনি আরও বলেন, কর্মস্থল বাদ দিয়ে নিজের বাসায় বসে দুর্নীতিতে নিমজ্জিত হলে এর দায়-দায়িত্ব নিজেকেই নিতে হবে। এসব কর্মচারীদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

ভুমি অধিগ্রহণ শাখায় সক্রিয় ৯০ দালাল কক্সবাজার ভূমি অধিগ্রহণ শাখায় অন্তত ৯০ জন দালাল সক্রিয় রয়েছে। এইসব দালালদের মাধ্যমে সার্ভেয়াররা এ অপকর্ম চালিয়ে আসছে। এমনকি শতভাগ ঠিকঠাক আছে এ ধরনের জমিতেও ভুয়া মালিক সাজিয়ে মামলা ঠুকে কমিশন আদায় করে সার্ভেয়ার-দালাল সিন্ডিকেট।

জানা গেছে, ২০১৭ সালের ৩ এপ্রিল তৎকালীন ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা আবু সালামের স্বাক্ষরে দালালদের একটি তালিকা প্রকাশ করা হলেও বর্তমানে তা বেড়ে ৯০ জনে উন্নীত হয়েছে।

২০১৭ সালের তালিকায় যাদের নাম ছিল তারা হলেন মো. রফিক প্রকাশ ভেন্ডার রফিক, সাহাব উদ্দিন, সানা উল্লাহ, রনি, হেলাল, ফজল কাদের, আমির খলিফা, আলি মিয়া, বাবর চৌধুরী, শাহাদত হোসাইন, ছৈয়দ নুর, আবুল কাশেম, মৌলভী বশর, নুরুল আবচার, হাজি ফরিদ, মো.মামুন, হেলাল উদ্দিন, মোস্তাফিজ, হোছাইন, আরেফ আলী, আবুল হাশেম, সাদ্দাম হোসাইন, হাজী ছৈয়দ, নুরুল আবছার, শফিক, আমান উল্লাহ, মো. ইব্রাহিম, সোহেল, আবদুল মতিন, আছাদ উল্লাহ, মৌঃ হাবিবুর রহমান, রিদুয়ান, সরওয়ার, দিদার, চট্টগ্রামের মুছা, ঢাকার মিঠুন, আহাদ, উখিয়ার হেলাল উদ্দিন ও বশর।

গত বছর থেকে মাতারবাড়ি প্রকল্প ছাড়াও রেললাইন প্রকল্প ও মহেশখালীর কালারমারছড়া এবং হোয়ানকে জমি অধিগ্রহণ শুরু হলে দালালের সংখ্যা বেড়ে যায়। এলএ শাখা কেন্দ্রিক দালালিতে জড়িয়ে পড়ে অন্তত ২৫/৩০ জন পেশাজীবী। যারা নিজেদের পেশা ছেড়ে দিয়েছে এলএ শাখায় দালালি করার জন্য।

এসব নতুন দালালদের মধ্যে তৎপর রয়েছে কালারমরাছড়া সোনার পাড়ার জালাল উদ্দিন, চিকনী পাড়ার জাফর আলম, নুরুল ইসলাম বাহাদুর, শাপলাপুর ইউনিয়নের সেলিম, হোয়ানকের ইব্রাহিম (হোটেল গার্ডেনে অফিস), মাতারবাড়ি রাজঘাটের হেলাল, শাপলাপুরের দিদারুল আলম (হোটেল নিরিবিলিতে অফিস), কালারমারছড়া ইউনিয়নের ছমিরাঘোনার আব্দুল হান্নান, ফকিরজুম পাড়ার মামুন, আধাঁরঘোনার মৃত সিকদার মিয়ার ছেলে আমান উল্লাহ, মৃত নজির আহমদের ছেলে আবুল হোসেন, মৃত দৌলত মিয়ার পুত্র বাদল, কালারমারছড়ার নুনাছড়ি এলাকার লকিয়ত উল্লাহ, মাতারবাড়ির হোছাইন (অফিস হোটেল নিরিবিলি), ধলঘাটা ইউনিয়নের তাজ উদ্দিন (হোটেল সৈয়দিয়ায় অফিস), পেশকারপাড়া এলাকার মো. মুবিন ওরফে উত্তরবঙ্গের মুবিন, মাতারবাড়ি ইউনিয়নের সাগর, ডুলাহাজারার বালুর চরের মিনহাজ, টার্মিনাল এলাকার হানিফ, সুগন্ধা পয়েন্টের ওয়াসিম, ঈদগাঁও এলাকার মো. তৈয়ব, রশিদ নগর ইউনিয়নের মো. শাহজাহান, ধলঘাটার মো. শফিউল আলম (গাড়ির মাঠ), শহরের কলাতলী এলাকার সাজ্জাদ প্রমুখ। চলমান অভিযান থেকে বাঁচতে তারা প্রত্যেকেই গা ঢাকা দিয়েছে।

জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন জানান, দালালের খপ্পরে না পড়ার জন্য বারবার সবাইকে বলা হচ্ছে। যেকোনো অভিযোগ তাৎক্ষণিক নিষ্পত্তি করা হচ্ছে। সরকারি অফিস মানুষের সেবার জন্য। হয়রানি বা অনিয়ম কোনোভাবেই মেনে নেওয়া হবে না। কেউ অভিযোগ করলেই তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

পাঠকের মতামত: