কক্সবাজার, বৃহস্পতিবার, ২ মে ২০২৪

প্রতিদিনই হোক মায়ের জন্যে

হেরিলে মায়ের মুখ দূরে যায় সব দুখ/ মায়ের কোলেতে শুয়ে জুড়ায় পরান/ মায়ের শীতল কোলে সকল যাতনা ভুলে/ কত না সোহাগে মাতা বুকটি ভরান…। মাকে নিয়ে হৃদয় নাড়িয়ে দেয়া কবি নজরুল ইসলামের কবিতাটি কার জানা নেই! আর ইংরেজ কবি রবার্ট ব্রাউনিং বলেছেন যে, ‘মাতৃত্বেই সকল ভালোবাসার শুরু এবং শেষ।’ সন্তানের জন্যে মায়ের ভালবাসা শর্তহীন, স্বার্থহীন, অন্তহীন ও বিনিময়হীন- জীবনের অন্তিম মুহূর্তেও যার শেষ নেই। বিশ্ব মা দিবস আজ। সবচেয়ে পবিত্র ও মধুর শব্দের নাম ‘মা’। যার কল্যাণে পৃথিবীতে আলোর মুখ দেখে সন্তান। মাত্র এক অক্ষরের শব্দটি আমাদের যেভাবে তৃপ্ত করতে পারে, পৃথিবীর আর কিছু তা পারে না। চিরন্তন একটি আশ্রয়ের নাম হলো মা। এই মা শব্দের মধ্যে লুকিয়ে আছে স্নেহ, মমতা আর অকৃত্রিম স্নেহ। সেই মায়ের স্মরণে প্রতি বছর মে মাসের দ্বিতীয় রবিবার ‘বিশ্ব মা দিবস’ হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। যদিও মাকে ভালোবাসা-শ্রদ্ধা জানানোর কোনো দিনক্ষণ ঠিক করে হয় না, তবুও মাকে গভীর মমতায় স্মরণ করার দিন আজ। তবে মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালবাসা দেখানো একটা বিশেষ দিনের ব্যাপার নয়। বরং এটা হওয়া উচিত প্রতিদিনের ব্যাপার। মা দিবস হওয়া উচিৎ প্রতিদিনই।

পবিত্র কুরআনের সূরা বনী ইসরাইলে আল্লাহ পাক বলেছেন, ‘তোমার প্রভু আদেশ করেন যে, তাঁকে ছাড়া অন্য কারো ইবাদত করো না এবং মাতা-পিতার সংগে সদ্ব্যবহার কর।’ মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) স্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছেন, ‘মায়ের পদতলে সন্তানের বেহেশত।’

একজন মা সন্তান প্রসবের সময় যে তীব্র ব্যথা অনুভব করেন পুরুষরা তার অতি কিঞ্চিৎ পরিমাণ ব্যথা হার্টএটাক হলেই কেবল বুঝতে পারেন। আর হার্ট এটাকের ব্যথা যে কত অসহনীয় তা কেবল ভুক্তভোগীরাই জানেন। সন্তানকে লালন-পালন করার কষ্টকর কাজটিও করেন মা।

কিছু সন্তান খুব সহজেই ভুলে যান যে, তাদের জীবনের অস্তিত্ব, সাফল্য ও উৎকর্ষতায় মায়ের ভুমিকা সীমাহীন, দিগন্ত বিস্তৃত এবং তুলনাবিহীন। আর মায়ের ভালোবাসা? কিসের সাথে তুলনা করা যায়? মা ও সন্তানের সম্পর্ক জাগতিক সব স্বার্থ, দেনা-পাওনার উর্ধ্বে। অনেক সময় সন্তানের দিক থেকে এই সম্পকের্র মূল্য দেয়া না হলেও যে কোন মা তার সন্তানের জন্য সবসময় সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত। সেই পুরনো গল্পটা আরেকবার মনে করা যাক : “প্রেমিকা প্রেমিককে বলল, তাকে পেতে হলে একটা পরীক্ষা দিতে হবে। যদি প্রেমিক তার মায়ের কলিজাটা ছিঁড়ে প্রেমিকার হাতে দিতে পারে তবেই সে প্রেমের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবে। প্রেমে অন্ধ প্রেমিক তা-ই করল। নিজের মায়ের কলিজাটা ছিঁড়ে প্রেমিকার উদ্দেশ্যে দৌড় দিল। পথের মাঝে হঠাৎ সে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল। আর মায়ের কলিজাটা সঙ্গে সঙ্গে সন্তানের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো, খোকন ব্যথা পাস্নি তো?” সন্তানের প্রতি মায়ের এই আকুলতা বিশ্বব্রহ্মান্ডে আর কিসের সাথে তুলনীয়?

বিশ্ব মা দিবসের ইতিহাস সম্পর্কে যতদূর জানা যায়, প্রাচীন গ্রীসের লোকেরা বসন্ত উৎসবের দেবতার মা বিয়া’কে নানাবিধ উপাচার উৎসর্গ করত। রোমানরাও তাদের দেবীর উদ্দেশ্যে মাদার্স ডে পালন করতো মার্চ মাসে। খ্রিস্টান সমাজ সেই ঐতিহ্যের অনুসরণে যীশুখৃস্টের কুমারী মাতা মেরীকে সম্মান জানানোর উদ্দেশ্যে মার্চ মাসের চতুর্থ রবিবার মাদার্স ডে পালন শুরু করে। আধুনিককালে মা দিবসের এর প্রবর্তন করেন এক মার্কিন নারী। ১৯০৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের আনা জারভিস নামের নারী মারা গেলে তার মেয়ে আনা মারিয়া রিভস জারভিস মায়ের কাজকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য সচেষ্ট হন। ওই বছর তিনি সান ডে স্কুলে প্রথম এ দিনটি মাতৃদিবস হিসেবে পালন করেন। ১৯০৭ সালের এক রবিবার আনা মারিয়া স্কুলের বক্তব্যে মায়ের জন্য একটি দিবসের গুরুত্ব ব্যাখ্যা করেন। ১৯১৪ সালের ৮ মে মার্কিন কংগ্রেস মে মাসের দ্বিতীয় রবিবারকে ‘মা’ দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। এভাবেই শুরু হয় মা দিবসের যাত্রা। এরই ধারাবাহিকতায় আমেরিকার পাশাপাশি মা দিবস এখন বাংলাদেশসহ অস্ট্রেলিয়া, ব্রাজিল, কানাডা, চীন, রাশিয়া ও জার্মানসহ শতাধিক দেশে মর্যাদার সঙ্গে দিবসটি পালিত হচ্ছে।

মা দিবস পালনের মাধ্যমে যদি সমাজে মায়েদের ব্যাপারে সন্তানদের সচেতনতার মাত্রা কিছুটা বৃদ্ধি পায় তবে ক্ষতি কী? তবে এক মুহূর্তের জন্যও ভুলে গেলে চলবে না যে, বাবা-মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা দেখানো একটা বিশেষ দিনের ব্যাপার নয় । বরং এটা প্রতিদিনের ব্যাপার।
বিশ্ববরেণ্য মনীষীদের জীবনী আলোচনা করলে দেখা যায় তাঁদের জীবনের একটা বড় অংশ জুড়ে আছে বাবা-মায়ের প্রতি তাদের অফুরন্ত ভক্তি-শ্রদ্ধার বিষয়টা। আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্যে, ধর্মীয় বিধি-বিধানে ও সামাজিক রীতিনীতিতে বাবা-মাকে সম্মান জানানোর এবং তাদের প্রতি কর্তব্য পালনের সর্বোত্তম আদর্শের প্রচলন রয়েছে। তাই আমাদের উচিত হবে সবার জীবনে সে আদর্শের চর্চা ও অনুশীলন করা।
মা পার্থিব কল্যাণের নিরন্তর উৎস আর পারলৌকিক মুক্তির অমূল্য সনদ। তাই অসহায় বৃদ্ধা মাকে গ্রামের বাড়িতে কিংবা বৃদ্ধাশ্রমে কিংবা অন্য কোথাও না পাঠিয়ে সসম্মানে নিজের সাথে রাখুন কিংবা আপনি আপনার মায়ের সাথে থাকুন। বৃদ্ধাবস্থায় সন্তানকে সবসময় পাশে পাওয়া এবং দেখার চেয়ে বড় উপহার কোন মায়ের জন্য হতে পারে না। সবশেষে আজকের এ দিনে বিশ্বের সব মায়ের প্রতি জানাই গভীর ভালবাসা আর অন্তহীন শ্রদ্ধা।
কবির ভাষায় আবার বলতে হয়-‘‘আয় তবে ভাইবোন, আয় তবে আয় শোন/ গাই গান পদধূলি শিরে লয়ে মা’র/ মা’র বড় কেউ নাই, কেউ নাই কেউ নাই/ নত করি বল সবে ‘মা আমার’ ‘মা আমার’।’

পাঠকের মতামত: