কক্সবাজার, রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪

রোহিঙ্গা মুসলমানদের শেষ করাই ছিল লক্ষ্য

অবশেষে মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়নকে ‘জেনোসাইড’ হিসেবে স্বীকার করেছে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন গতকাল সোমবার সন্ধ্যায় ওয়াশিংটন ডিসিতে হলোকস্ট মেমোরিয়াল মিউজিয়ামের এক অনুষ্ঠানে রোহিঙ্গা নিপীড়নকে জেনোসাইড হিসেবে ঘোষণা দেন। আইনি সংজ্ঞা অনুযায়ী, ‘জেনোসাইড’ ‘গণহত্যার’ (মাস কিলিং) চেয়েও বড় কিছু। এর মূল উদ্দেশ্য কোনো জাতি বা গোষ্ঠীকে ধ্বংস বা নিশ্চিহ্ন করা।

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্লিংকেন বলেছেন, ২০১৬ ও ২০১৭ সালে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর হামলার মাধ্যমে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলমান জনগোষ্ঠীকে ধ্বংস করার স্পষ্ট অভিপ্রায় ছিল।

তখন মিয়ানমারে সামরিক অভিযানের মুখে আট লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে। এ ছাড়া অনেক রোহিঙ্গা হত্যার শিকার হয়েছে।

ব্লিংকেন তাঁর বক্তব্যে যুক্তরাষ্ট্রের তদন্ত প্রতিবেদন থেকে রোহিঙ্গাদের ধর্ষণ, নির্যাতন ও নিপীড়নের শিকার হওয়ার বিভিন্ন ঘটনা তুলে ধরেন। একজন রোহিঙ্গা নারী মিয়ানমারের সেনাদের অনুরোধ করেছিলেন তাঁকে যেন অন্তত সন্তানদের সামনে ধর্ষণ করা না হয়। কিন্তু মিয়ানমারের সেনারা কোনো অনুরোধ রাখেনি।

তিনি বলেন, মিয়ানমারের রাখাইনে একদিকে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে অভিযান চলছিল, অন্যদিকে সেখান থেকে পালানোর পথগুলো ছিল বন্ধ। রোহিঙ্গাদের ধ্বংস করাই ছিল সামরিক বাহিনীর লক্ষ্য। কারণ মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের নাগরিক বলে স্বীকার করে না।

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, গত বছর ফেব্রুয়ারিতে সামরিক অভ্যুত্থানের পর মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী একই কৌশল অবলম্বন করেছে। এখনো মিয়ানমারের কেউ নিপীড়ক শাসককে অবজ্ঞা করলে বা বিরোধিতা করলে হামলার লক্ষ্যে পরিণত হচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়নের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও বিশ্লেষণে স্বাধীন কাঠামো ‘ইনডিপেনডেন্ট ইনভেস্টিগেটিভ মেকানিজম ফর মিয়ানমারকে (আইআইএমএম)’ ১০ লাখ মার্কিন ডলার অতিরিক্ত তহবিল দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি নৃশংস অপরাধ রোধ ও জবাবদিহি.

নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক সমর্থন জোরদারের উদ্যোগের কথাও জানান।

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্লিংকেন বলেন, ‘আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালতেই শুধু নয়, আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালত (আইসিসি) ও সর্বজনীন বিচারিক এখতিয়ারের আওতায় আর্জেন্টিনার আদালতেও প্রচেষ্টা এগিয়ে চলছে। জঘন্য অপরাধের জন্য দায়ীদের জবাবদিহির দিন আসবে। ’

হলোকস্ট মিউজিয়ামের ওই অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ পেয়েছিলেন রোহিঙ্গা অধিকারকর্মী বার্মিজ রোহিঙ্গা অর্গানাইজেশন ইউকের (ব্রুক) সভাপতি তুন খিন। গত রাতে কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, তিনিসহ প্রত্যেক রোহিঙ্গার জন্য এটি এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত। এত দিন রোহিঙ্গারা বলে আসছিল যে তারা জেনোসাইডের শিকার। অবশেষে যুক্তরাষ্ট্রও এটি স্বীকার করল।

তুন খিন বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে রোহিঙ্গা জেনোসাইডের সামাজিক স্বীকৃতি শুরু হলো। এটি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রোহিঙ্গাদের মানবাধিকারসহ বিভিন্ন অধিকার প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখবে। বিশেষ গুরুত্ব পাবে বিচারপ্রক্রিয়ায়। এখন মিয়ানমারে আরো জেনোসাইড ও মানবতাবিরোধী অপরাধ ঠেকাতে এবং মিয়ানমারের জেনারেলদের জবাবদিহির আওতায় আনার চেষ্টা জোরালো হবে।

মানবাধিকার সংগঠন ফোরটিফাই রাইটসের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ম্যাথু স্মিথ বলেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্লিংকেনের ঘোষণা রোহিঙ্গা ও মিয়ানমারের জনগণ এবং বৃহৎ পরিসরে জেনোসাইড প্রতিরোধ ও প্রতিকারের উদ্যোগের জন্য ঐতিহাসিক ঘটনা হয়ে থাকবে। জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলোর উচিত মিয়ানমারে রোহিঙ্গা জেনোসাইডের বিষয়টি প্রকাশ্যে স্বীকার করা।

এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাম্প প্রশাসন রোহিঙ্গা নিপীড়নের তদন্ত ও আইনি বিভিন্ন দিক যাচাই-বাছাই করে শেষ পর্যন্ত একে ‘জেনোসাইড’ বলে ঘোষণা দেওয়া থেকে বিরত থেকেছিল। সে সময় যুক্তরাষ্ট্রের পলিটিকো জার্নালে ফাঁস হওয়া এক নথিতে রোহিঙ্গা নিপীড়নকে জেনোসাইড হিসেবে স্বীকার করা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের সংশ্লিষ্ট ব্যুরোগুলোর মতপার্থক্যের কথা জানা যায়। মানবাধিকারবিষয়ক ব্যুরোর অবস্থান ছিল জেনোসাইড ঘোষণার পক্ষে। অন্যদিকে পূর্ব এশিয়াবিষয়ক ব্যুরোর মত ছিল জেনোসাইড ঘোষণার বিপক্ষে। তাদের যুক্তি ছিল, গণতন্ত্রের পথে থাকা মিয়ানমারে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য যে সুযোগ ও সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে তা নষ্ট হবে। তা ছাড়া জেনোসাইড হিসেবে স্বীকৃতি দিলে জেনোসাইড প্রতিরোধবিষয়ক সনদে স্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য তা ঠেকানো বা প্রতিকার করা আবশ্যক হয়ে উঠবে। এর অর্থ মিয়ানমারকে সমর্থন দেওয়া চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের টানাপড়েন আরো বৃদ্ধি বা সংঘাতের আশঙ্কা।

নথি ফাঁস হওয়ার পর বিতর্কের মুখে ট্রাম্প প্রশাসন শেষ পর্যন্ত রোহিঙ্গা নিপীড়নকে ‘এথনিক ক্লিনজিং’ (জাতিগত নির্মূল) হিসেবে অভিহিত করার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। যুক্তরাষ্ট্র শেষ পর্যন্ত কবে নাগাদ রোহিঙ্গা জেনোসাইড হিসেবে স্বীকৃতি দিতে পারে তা নিয়েও নানা বিচার-বিশ্লেষণ চালানো হয়েছে। বিশ্লেষকদের অনেকে অতীতের উদাহরণ টেনে বলেছেন, যখন যুক্তরাষ্ট্রের আর তেমন স্বার্থ থাকবে না বা জেনোসাইড ঠেকাতে সামরিক বাহিনী পাঠানোর প্রয়োজন হবে না, তখন জেনোসাইড স্বীকার করতে পারে যুক্তরাষ্ট্র।

কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, যুক্তরাষ্ট্র যখন রোহিঙ্গা জেনোসাইড স্বীকার করে নিয়েছে তখন কার্যত মিয়ানমারে তার এখন আর তেমন স্বার্থ নেই বা লাভের আশা নেই। বরং জেনোসাইড ঘোষণার মধ্য দিয়ে মিয়ানমারের ওপর আরো চাপ সৃষ্টি করা যাবে। বিশ্লেষকদের মধ্যেও কেউ কেউ এমন অভিমত ব্যক্ত করেছেন। মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক সরকারকে উত্খাত করে ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছে জান্তা। মার্কিন চাপেও খুব একটা ফল হচ্ছে না। মানবাধিকারের প্রতি অঙ্গীকার থেকে পররাষ্ট্র নীতি সাজানোর অঙ্গীকার করে বাইডেন প্রশাসন ক্ষমতায় আসার ১৪ মাসের মাথায় যুক্তরাষ্ট্র রোহিঙ্গা জেনোসাইডকে স্বীকৃতি দিল।

ফ্রি রোহিঙ্গা কোয়ালিশনের সমন্বয়ক মং জার্নি এক টুইট বার্তায় বলেছেন, ‘গ্যাস ও রোহিঙ্গা জেনোসাইডের মধ্যে সম্পর্ক আছে? যখন শেভরন মিয়ানমার ছেড়েছে তখন মিয়ানমারে যুক্তরাষ্ট্রের আর এক ডলারেরও দায় নেই। এখন যুক্তরাষ্ট্র সত্যকে সত্য বলতে পারে। হয়তো ইউরোপীয় ইউনিয়নও (ইইউ) এখন যুক্তরাষ্ট্রকে অনুসরণ করবে। ফ্রান্সের গ্যাস কম্পানি টোটাল মিয়ানমার থেকে অনেক আয় করে কার্যক্রম গুটিয়ে নিয়েছে। ’

সাবেক পররাষ্ট্রসচিব এম শহীদুল হক কালের কণ্ঠকে বলেছেন, মিয়ানমারের ওপর চাপ বাড়ছে। ‘জেনোসাইডাল গভর্নমেন্টের’ (জেনোসাইড করেছে এমন সরকার) সঙ্গে অন্যান্য দেশ স্বাভাবিক সম্পর্ক রাখতে পারবে না। শক্ত অবস্থান নিতেই হবে। এর আগে রোহিঙ্গা নিপীড়নকে জেনোসাইড হিসেবে স্বীকার করে কানাডা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ও সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজের পরিচালক ইমতিয়াজ আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র রোহিঙ্গা নিপীড়নকে স্বীকৃতি দেওয়ার পরে কী করতে চাচ্ছে তা আমাদের দেখতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র যদি ওই স্বীকৃতির পাশাপাশি নিষেধাজ্ঞা ও বিচারের উদ্যোগ নেয় এবং তার মিত্রদের একই উদ্যোগ নিতে উৎসাহিত করে তাহলে কিছু ফল দেখা যেতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র যদি তার মিত্র ও অংশীদারদের মিয়ানমারের সঙ্গে ব্যবসা ও স্বাভাবিক সম্পর্ক বন্ধ করতে বলে তাহলেও প্রভাব দেখা যেতে পারে।

তিনি বলেন, হঠাৎ কেন যুক্তরাষ্ট্র এ উদ্যোগ নিল এটিও দেখা দরকার। একটি হতে পারে মিয়ানমারের প্রবাসী সরকারের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ভালো সম্পর্ক হয়েছে। প্রবাসী সরকার জাতিসংঘে সম্প্রতি ইউক্রেন ইস্যুতে রাশিয়ার বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র এখন মিয়ানমারের জান্তার ওপর চাপ বৃদ্ধি করতে চাচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্রের মিয়ানমারের দূতাবাসের কর্মকর্তারা এবং জান্তার একজন মুখপাত্র গত রবিবার মন্তব্যের অনুরোধ করে পাঠানো রয়টার্সের ই-মেইলের জবাব দেননি। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে জেনোসাইড করার কথা অস্বীকার করেছে। তারা বলেছে, সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে।

স্নায়ুযুদ্ধের পর থেকে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর আনুষ্ঠানিকভাবে ছয়বার ‘জেনোসাইড’ শব্দটি ব্যবহার করেছে। বসনিয়া, রুয়ান্ডা, ইরাক ও দারফুরের হত্যাযজ্ঞ, ইয়াজিদি.

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ও সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজের পরিচালক ইমতিয়াজ আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র রোহিঙ্গা নিপীড়নকে স্বীকৃতি দেওয়ার পরে কী করতে চাচ্ছে তা আমাদের দেখতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র যদি ওই স্বীকৃতির পাশাপাশি নিষেধাজ্ঞা ও বিচারের উদ্যোগ নেয় এবং তার মিত্রদের একই উদ্যোগ নিতে উৎসাহিত করে তাহলে কিছু ফল দেখা যেতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র যদি তার মিত্র ও অংশীদারদের মিয়ানমারের সঙ্গে ব্যবসা ও স্বাভাবিক সম্পর্ক বন্ধ করতে বলে তাহলেও প্রভাব দেখা যেতে পারে।

তিনি বলেন, হঠাৎ কেন যুক্তরাষ্ট্র এ উদ্যোগ নিল এটিও দেখা দরকার। একটি হতে পারে মিয়ানমারের প্রবাসী সরকারের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ভালো সম্পর্ক হয়েছে। প্রবাসী সরকার জাতিসংঘে সম্প্রতি ইউক্রেন ইস্যুতে রাশিয়ার বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র এখন মিয়ানমারের জান্তার ওপর চাপ বৃদ্ধি করতে চাচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্রের মিয়ানমারের দূতাবাসের কর্মকর্তারা এবং জান্তার একজন মুখপাত্র গত রবিবার মন্তব্যের অনুরোধ করে পাঠানো রয়টার্সের ই-মেইলের জবাব দেননি। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে জেনোসাইড করার কথা অস্বীকার করেছে। তারা বলেছে, সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে।

স্নায়ুযুদ্ধের পর থেকে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর আনুষ্ঠানিকভাবে ছয়বার ‘জেনোসাইড’ শব্দটি ব্যবহার করেছে। বসনিয়া, রুয়ান্ডা, ইরাক ও দারফুরের হত্যাযজ্ঞ, ইয়াজিদি এবং অন্য সংখ্যালঘুদের ওপর ইসলামিক স্টেটের হামলা এবং গত বছর উইঘুর ও অন্য মুসলিমদের প্রতি চীনের আচরণকে জেনোসাইড হিসেবে ঘোষণা করেছে। তবে চীন গণহত্যার অভিযোগ অস্বীকার করেছে।

 

ডব্লিউজি/এসএল

পাঠকের মতামত: