‘আমার ১৯ বছরের একটা ছেলে আছে। এই দেশে আসার আগে সে পড়ালেখা করতো। কিছু শিক্ষা পেটে থাকায় শুরুর দিকেই এনজিওরা তাকে কাজে রেখেছিল। তখন অনেক লোক লাগতো ওদের। কিন্তু আমরা ছেলে এখন আর ওই কাজগুলোও করতে চায় না। সারাদিন শুয়ে-বসে আড্ডায় কাটায়। এরমধ্যে সে একটা বিয়েও করেছে। এখন ক্যাম্পের সাহায্য আর মাঝে মধ্যে এদিক-সেদিক স্বেচ্ছাসেবকের কাজ করে কিছু আয় হয়। সারাক্ষণ ভয় হয়, খারাপ সঙ্গে না জড়িয়ে যায়।’ কথাগুলো বলছিলেন উখিয়ার ক্যাম্প ১৮ -এর এক রোহিঙ্গা মা। ক্যাম্পে এরকম হাজারো মা আছেন, যারা সারাক্ষণ সন্তানের সন্ত্রাসী কার্যক্রমে জড়িয়ে যাওয়ার ভয়ে থাকেন।
কারা তরুণ? তারা কী চায়?
বাংলাদেশে ২০১৭ সালের আগে থেকে অন্তত লাখচারেক রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছিল। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট সেনাচৌকিতে জঙ্গি হামলাকে অজুহাত দেখিয়ে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর জাতিগত নিধন শুরু করে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। এরপর থেকে পরের কয়েক মাসে বাংলাদেশে এসেছে আরও সাড়ে ৭ লাখ রোহিঙ্গা। সব মিলিয়ে এখন প্রায় সাড়ে ১১ লাখ রোহিঙ্গা রয়েছে বাংলাদেশে। কিন্তু এদের মধ্যে ঠিক কত জন এখন তরুণ, তার সুনির্দিষ্ট কোনও হিসাব মেলে না। তবে জাতিসংঘ শরণার্থী তহবিলের (ইউএনএইচসিআর) একটি হিসাব আছে, যেখানে বলা হচ্ছে— মোট জনসংখ্যার ১৪ শতাংশ হলো ১২ থেকে ১৭ বছর বয়সী এবং ৪৪ শতাংশ রোহিঙ্গার বয়স ১৮ থেকে ৫৯ বছরের মধ্যে। এই বিশাল সংখ্যার জনগোষ্ঠীর মধ্যে ৩০ থেকে ৪০ বছর বয়সীদের সংখ্যা বেশি বলে একটা ধারণা পাওয়া যায়।
লম্বাশিয়ার ক্যাম্প-১ ও ক্যাম্প-২, বালুখালীর-৮, ৯, ১৮ ক্যাম্পগুলো ঘুরে দেখা গেছে, ছোট ছোট চায়ের দোকানে তরুণদের আনাগোনা। টেবিলে জোট বেঁধে মোবাইলে কিছু একটা দেখছে। তারা কোনও কাজ করে কিনা জানতে চাইলে কেউই কথা বলতে আগ্রহী না। এমনকি মোবাইল থেকে মুখ তুলেও তাকায় না। পাশের টেবিলে চায়ের কথা বলতে বসার চেষ্টা করলে একে একে উঠে বেরিয়ে যায় সবাই।
এই তরুণরা কাজ চায়। তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ক্যাম্পের এই জীবন আরও দীর্ঘ হতে পারে, এই শঙ্কায় তারা টাকা আয়ে মনোযোগী হতে চায়। এবং বিদেশে যাওয়ার প্রতি তাদের তীব্র টান লক্ষণীয়।
অর্থনৈতিক সুযোগের পাশাপাশি আকাঙ্ক্ষার জায়গাগুলো বুঝতে ক্যাম্পগুলোতে বসবাসকারী ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সী বাস্তুচ্যুত তরুণ রোহিঙ্গাদের ওপর একটি সমীক্ষা চালায় পপুলেশন কাউন্সিল। লক্ষণীয়, এই বয়সীদের মধ্যে ৬৩ শতাংশ তরুণ রোহিঙ্গা নারী এবং ৫৪ শতাংশ তরুণ রোহিঙ্গা পুরুষ বিবাহিত। বিপুল সংখ্যক তরুণ রোহিঙ্গা স্কুলে পড়েছে (পুরুষ ৬২ শতাংশ, নারী ৪৩ শতাংশ)। কিন্তু তরুণ রোহিঙ্গা জনসংখ্যার মধ্যে, ৫৪ শতাংশ পুরুষ এবং ৭২ শতাংশ নারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করেনি। তরুণ পুরুষ রোহিঙ্গারা প্রধানত মেকানিক্স, কম্পিউটার, প্যারামেডিসিন, ইংরেজি ভাষা এবং রাজমিস্ত্রির ওপর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে এবং তরুণ নারী রোহিঙ্গারা সেলাই, ব্লক/বুটিক, ইংরেজি ভাষা, আর্থিক সাক্ষরতা এবং প্যারামেডিসিন বিষয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে।
দিনমজুর না ওরা স্বেচ্ছাসেবক
চাল ডাল তেল চিনি লবণসহ নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস দেওয়া হয় সাহায্য হিসেবে। এর পরিমাণ প্রয়োজনের অতিরিক্ত হয় তো কম না। কিন্তু তারপরেও চলার জন্য টাকার দরকার হয়। সবতো আর রিলিফের তালিকায় থাকে না। আবার ক্যাম্পের মধ্যে প্রাইভেটে পড়ালেখা করতেও অনন্ত ৩০০ টাকা দিতে হয় মাসে। সেক্ষেত্রে এই টাকা কোথায় পাবে? যদিও ক্যাম্পে দৈনন্দিন কিছু কাজ থাকে, সেগুলো করা হয়। যেমন- ড্রেন পরিষ্কার, ক্যাম্পের ভেতর সিঁড়ি মেরামত, ঘর সারাই, এটা-ওটা টানাটানি করে দেওয়া। এই কাজগুলোও দিনের একটা অংশে হয়, বা কোনও কোনো দিন হয় না। ফলে পুরোটা সময়ই অলস কাটাতে হয়।
প্রশিক্ষণ পায়, কিন্তু তারপরে কী?
বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান যারা ক্যাম্পে কাজ করে, তারা নানাভাবে তরুণ এই গ্রুপকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা করলেও মনোযোগ ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। একটি সংস্থার এক কর্মী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আমরা সাবান, ব্যাগ বানানো, সেলাই শেখানো যাই করি না কেন, প্রশিক্ষণের পরে তারা কী করবে? সেই উত্তর দিতে না পারা পর্যন্ত এরা এই কাজে মনোযোগী হবে না। বা এক দল প্রশিক্ষণ নেওয়ার পরে আরেক দল আর নিতেই চাইবে না। এরা বিদেশে থাকা স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ করে সাগরপথে বিদেশ পাড়ি দিচ্ছে। এরমধ্যে মেয়েরাও আছে। নানা কারণে ক্যাম্পে মেয়েদের কাজের কোনও পরিবেশ নেই। এখানে মেয়েরা প্রায় অদৃশ্য।
একবার হলেও ইয়াবার চালান আনার পরিকল্পনা
তরুণদের মধ্যে ইয়াবার চালান আনার আকাঙ্ক্ষা রয়েছে। বর্ডার এলাকায় হওয়ার কারণে টেকনাফ এলাকার ক্যাম্পগুলোতে এই প্রবণতা বেশি। দীর্ঘদিন ক্যাম্পবন্দি থাকার কারণে হতাশার জীবন থেকে বের হতে অর্থ উপার্জনকে বড় করে দেখে এই তরুণরা। মাত্র ২৫ বছরে দুই সন্তানের জনক এক ব্যক্তি বলেন, আমার পাশের কোনও এক ব্যক্তি যখন একটু ঝুঁকি নিয়ে ইয়াবার একটা-দুইটা চালান এনে ভালো জীবন যাপন করছে, তখন আমার ওপর চাপ থাকে। আমার বৈধ কোনও আয় নেই। কিন্তু পরিবার চালাতে টাকা লাগে। অনেকেই আছে যারা বিদেশ যাওয়ার সব ঠিক করে, একটা ইয়াবা চালান এনে টাকা নিয়ে চলে যায়।
দুর্বৃত্তদের সোর্স একটা কাজ
দিনমজুরের কাজ করেন, ক্যাম্পের ঘর সারাই করেন, এমন এক রোহিঙ্গা বলেন, ‘ক্যাম্পে আমাদের কোনও আয় নেই। কারণ, আমাদের ক্যাম্পের বাইরে কাজে যেতে দেওয়া হচ্ছে না। কতদিনে আমরা ফিরতে পারবো তাও জানি না। ফলে অলস সময় পার করা ছাড়া বেশিরভাগের কোনও কাজ নেই।’
তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ক্যাম্পে অনেকগুলো সংগঠন আছে। নানা নামে তারা আধিপত্য বিস্তার করে। একটু পড়ালেখা জানে এমন ছেলেদের তারা ব্যবহার করে। ক্যাম্পে কারা আসছে, কী নিয়ে কথা বলছে, সংস্থাগুলো যারা কাজ করে তারা কী ধরনের বার্তা দেয়— এসব নিয়মিত খোঁজ রাখা এবং নেতাদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার কাজটা করে তারা কিছু অর্থ উপার্জন করে। তবে সেই সংখ্যা খুব বেশি না।’
তরুণদের মধ্যে ভবিষ্যৎ নিয়ে হতাশা তৈরি হয়েছে উল্লেখ করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃ-বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. রাহমান নাসির উদ্দিন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘কেবল বাংলাদেশে নয়, শরণার্থী ব্যবস্থাপনায় সব সময়ই তরুণদের অবহেলা করা হয়। নারী শিশু স্বাস্থ্য সব বিষয়ে কাজ থাকে, কিন্তু তরুণদের নিয়ে কাজ নেই। ২০১৯-২০ এর দিকে আমরা একটি গবেষণা করে দেখতে চেয়েছিলাম— এই বিশাল জনগোষ্ঠীর তরুণ নারী-পুরুষদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা যায় কিনা। সেটা সম্ভব হয়নি। তারা বৈধভাবে কোনও কাজ করতে পায় না। ফলে ক্রমবর্ধমান আন্তকোন্দল, উপদলে ভাগ হয়ে অপরাধে জড়িয়ে পড়া, সীমান্ত অবৈধ বাণিজ্য করার দিকে তারা ঝুঁকে যায়।’ তিনি বলেন, ‘আরাকান থেকে বাংলাদেশে ঢোকার রাস্তা তাদের ভালোমতো চেনা বলে বড় ব্যবসায়ীরা তাদের চোরাচালানের জন্য ব্যবহার করছে।’
তরুণদের বিষয়ে পর্যবেক্ষণ জানতে চাইলে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এটা জাতীয় নীতি নির্ধারণীর বিষয়। এই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে জায়গা দেওয়া হয়েছে, তাদের জীবন-যাপনের জন্য আন্তর্জাতিক সহায়তায় নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস দেওয়া হয়। কিন্তু তাদের দক্ষতা বৃদ্ধির কোনও প্রশিক্ষণের বিষয়ে কোনও সিদ্ধান্ত হয়নি। কিছু কিছু সংস্থা নানা প্রশিক্ষণ অনানুষ্ঠানিকভাবে দিয়ে থাকে, কিন্তু সেটা ওই পর্যন্তই।’ তিনি বলেন, ‘তারা বাংলাদেশি নাগরিক না। তাদের কাজের অনুমতি নেই, তাহলে কোন উপায়ে তারা বাংলা টাকা আয় করবে?’ ভেতরে দিনমজুর হিসেবে কিছু টাকা আয় করে কিনা প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘দিনমজুর না, তারা স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কিছু কাজ করার সুযোগ পায়।’ কিছু করার সুযোগ নেই বলে তরুণেরা দেশ ছেড়ে যাচ্ছে— এমন অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এই তরুণদের কোনও আশা নেই, স্বপ্ন নেই, উদ্দেশ্যহীন জীবন। ফলে এমন পদক্ষেপ তারা নিতে চেষ্টা করবেই।’
পাঠকের মতামত: