কক্সবাজার, রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪

রোহিঙ্গাদের এনআইডি জালিয়াতির মামলা তদন্তের অগ্রগতি কত দূর?

রোহিঙ্গাদের জাতীয় পরিচয়পত্র দেওয়ার মামলা হওয়ার পর তিন বছরের বেশি সময় পার হয়ে গেলেও এসব মামলার তদন্তের কোনো অগ্রগতি নেই। ফলে রোহিঙ্গাদের মধ্যে জালজালিয়াতির মাধ্যমে জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি করাও বন্ধ হচ্ছে না।

মিয়ানমার সেনা অভিযানের কারণে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা পাচ্ছে বাংলাদেশি জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি)। এক লাখ থেকে দুই লাখ টাকার বিনিময়ে রোহিঙ্গারা পাচ্ছে বাংলাদেশের জাতীয় পরিচয়পত্র। ফলে তারা সহজেই বনে যাচ্ছে বাংলাদেশি নাগরিক। তাদের এ কাজে সহযোগিতা করছে রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পের কিছু দালাল, বাংলাদেশি কিছু জনপ্রতিনিধি আর নির্বাচন কমিশনের কিছু অসাধু কর্মকর্তা। এরই মধ্যে কয়েকজন জনপ্রতিনিধির বিরুদ্ধে মামলাও হয়েছে। নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে চলছে তদন্ত।

কিছুদিন আগে একটি অনুষ্ঠানে সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার ড. এ টি এম শামসুল হুদা বলেন, ‘মাঝখানে রোহিঙ্গাদের এনআইডি কার্ড নিয়ে কিছু জালিয়াতি হয়েছে। রোহিঙ্গারা এ দেশের নাগরিক নয়, কিন্তু তারা কার্ড পাচ্ছে। যারা এ কাজ করছে তাদের ধরেন। কারাগারে পাঠান। এদের কারণে দেশের বদমান হচ্ছে।’

একটি সূত্র জানায়, রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশি এনআইডি জালিয়াতিতে জড়িত বেশ কয়েকটি সিন্ডিকেট। তারা কয়েকটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে এ জালিয়াতির কাজ করে। রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পে সক্রিয় দালাল চক্র ক্যাম্প থেকে এনআইডি করাতে আগ্রহী রোহিঙ্গাদের নিয়োগ করে। এরপর বাংলাদেশি দালাল চক্রের মাধ্যমে জন্মনিবন্ধন, জাতীয়তা সনদপত্র এবং অন্যান্য দলিল তৈরি করে। সর্বশেষ ধাপে নির্বাচন কমিশনের কতিপয় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাধ্যমে এনআইডি তৈরি করা হয়।

এনআইডি তৈরি করতে একেকজন রোহিঙ্গাকে গুণতে হয় এক লাখ ২০ হাজার থেকে দুই লাখ টাকা পর্যন্ত। এর মধ্যে নির্বাচন অফিস নেয় ৫০ হাজার থেকে ৭০ হাজার টাকা, জন্মনিবন্ধন ও জাতীয়তা সনদ তৈরির সিন্ডিকেট নেয় ২০ হাজার থেকে ৪০ হাজার টাকা এবং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের দালাল চক্র নেয় ৫০ হাজার থেকে ৭০ হাজার টাকা।

রোহিঙ্গাদের এনআইডি জালিয়াতিতে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে চট্টগ্রাম অঞ্চলের কিছু জনপ্রতিনিধি, প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তি এবং নির্বাচন কমিশনের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। তাদের মধ্যে কারও কারও বিরুদ্ধে মামলাও হয়েছে। এরই মধ্যে রোহিঙ্গাদের এনআইডি সরবরাহে জড়িত থাকার অভিযোগে নিজেদের এক সিনিয়র কর্মকর্তার বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছে নির্বাচন কমিশন।

ওই অভিযোগ তদন্তে নির্বাচন কমিশনের মহাপরিচালক এ কে এম হুমায়ুন কবীরকে তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। নির্বাচন কমিশনের সহকারী সচিব মোহাম্মদ শহীদুর রহমান গত ৩১ মে এ ঘটনা তদন্ত করে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য চিঠি দেন।

রোহিঙ্গাদের এনআইডি নিয়ে অভিযোগ তদন্ত করা দুদকের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, রোহিঙ্গাদের এনআইডি সরবরাহে জড়িত রয়েছে শক্তিশালী সিন্ডিকেট। সিন্ডিকেটের সদস্যরা আত্মীয় পরিচয়ে রোহিঙ্গাদের শনাক্ত করে। এ সিন্ডিকেটে রয়েছে রোহিঙ্গা নাগরিক, জনপ্রতিনিধি ও নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তা-কর্মচারী। সিন্ডিকেটের সদস্যরা জন্মসনদ, নাগরিক সনদ, বাবা-মায়ের এনআইডি, বাসার ইউটিলিটি বিলের কপি সরবরাহ করে রোহিঙ্গাদের এনআইডি প্রাপ্তিতে সহায়তা করে।

কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের (সিটিটিসি) একটি সূত্র বলছে, ‘রোহিঙ্গাদের এনআইডি প্রাপ্তিতে তিনটি গ্রুপ বিভক্ত হয়ে কাজ করে। একটি গ্রুপ রোহিঙ্গাদের জোগাড় করে। আরেকটি গ্রুপ ডকুমেন্ট তৈরি করে। শেষ গ্রুপটি এনআইডি তৈরির কাজ ত্বরান্বিত করে।’

মামলার তদন্ত

আর্থিক সুবিধা নিয়ে রোহিঙ্গাদের জাতীয় পরিচয়পত্র দেওয়ার ঘটনায় পাঁচটি অভিযোগ তদন্ত করেছে দুদক। অভিযোগের সত্যতা পাওয়ায় একাধিক মামলা করা হয়েছে। এসব মামলায় জেলা নির্বাচন কার্যালয়ের অফিস সহায়ক, ডাটা এন্ট্রি অপারেটর, জনপ্রতিনিধিসহ বিভিন্নজনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। এ মামলায় বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে।

মামলাগুলোর অগ্রগতি বিষয়ে দুদক সমন্বিত জেলা কার্যালয়-২-এর উপ-পরিচালক আতিক আলম ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘মামলাটির তদন্ত চলমান রয়েছে। কিছু তথ্যের ঘাটতি থাকায় প্রতিবেদন দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। আমাদের প্রচেষ্টা রয়েছে দ্রুত মামলার প্রতিবেদন প্রক্রিয়া শেষ করার।’

রোহিঙ্গাদের এনআইডি জালিয়াতির একটি মামলা তদন্ত করছে চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের (সিএমপি) কাউন্টার টেররিজম ইউনিট। এরই মধ্যে দালাল চক্রের তিন সদস্যসহ বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। প্রায় তিন বছর ধরে মামলাটির তদন্ত চলছে।

এ বিষয়ে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সঞ্জয় সিনহা বলেন, ‘এ মামলার তদন্ত শেষ করতে নির্বাচন কমিশন থেকে কিছু তথ্য চাওয়া হয়েছে। কিন্তু পর্যাপ্ত তথ্য সরবারহ না করায় ফের তথ্য চাওয়া হয়েছে। ওই তথ্যগুলো হাতে পেলে এ মামলার তদন্তের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হবে।’ ঢাকাটাইমস

পাঠকের মতামত: