মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের কারণে বাংলাদেশ এমনেতেই জনসংখ্যার উচ্চঝুঁকিতে রয়েছে। লাখ লাখ রোহিঙ্গা বাস্তুচ্যুত হওয়ার পর মোটাদাগে আরও অন্তত ১০ ধরনের ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে এই জনগোষ্ঠীর মধ্যে স্বাস্থ্য ঝুঁকিই এখন বড় উদ্বেগজনক হয়ে দাঁড়িয়েছে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মিয়ানমার থেকে বিতারিত হওয়া এই জনগোষ্ঠী রোহিঙ্গা শিবিরে আশ্রয় নেয়ার পর একের পর এক ঝুকির মধ্যে পড়ছে কক্সবাজারের ‘উখিয়া’ ও ‘টেকনাফ’ উপজেলা।
এ অঞ্চলে ডেঙ্গু, ডায়রিয়া, কলেরা, হেপাটাইটিস ‘বি’ এবং ‘সি’ ভাইরাসসহ নানা রোগের প্রদুর্ভাব বেড়েছে গত কয়েকবছর যাবত। বিশেষ করে ভয়ংকর রকমের উদ্বেগ তৈরি করেছে ‘এইচআইভি‘ (হিউম্যান ইমিউনোডিপেন্সি ভাইরাস) বা ‘এইডস’ রোগ। এইডস রোগীর সংখ্যা দিনদিন বেড়েই চলেছে। প্রতিদিনই এইডস-এ আক্রান্ত রোগী সন্ধ্যান মিলছে। তবে এসব রোগী রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাইরে অবাধ চলাফেরা করায় এইডস ছড়িয়ে যাচ্ছে। এর ফলে শুধু কক্সবাজার নয়, সারা দেশের মানুষের জন্য মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরির আশঙ্কা রয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, কক্সবাজার সদর হাসপাতাল ও সংশ্নিষ্ট বেসরকারি সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, রোহিঙ্গাদের মধ্যে এইডস রোগীর হার বিগত ছয় বছরে বেড়েছে ৭০-৮০ শতাংশ। সূত্র আরও জানায়, ২০১৫ সালের দিকে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে এইডস রোগী শনাক্তকরণ কার্যক্রম শুরু হয়। তবে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বাংলাদেশে ঢোকার পর ২০১৭ সালের অক্টোবর থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত কক্সবাজারে ৫৩৮ জনের শরীরে ভাইরাসটি শনাক্ত হয়। তাদের মধ্যে ৩৯৫ জনই রোহিঙ্গা।
জাতিসংঘের এইডসবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইডসের মতে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এইডস ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম ‘মিয়ানমার’। মিয়ানমারের মোট জনসংখ্যার প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে হাজারে আটজনই এইডস রোগে আক্রান্ত। এদের পরিবারের সবার মধ্যেই রোগ সংক্রমিত হয়েছে।
এর আগেও মিয়ানমার থেকে বিভিন্ন সময়ে আসা রোহিঙ্গাদের মধ্যে এইডস রোগী পাওয়া গেছে। অন্যদিকে, বাংলাদেশে এইডস রোগীর সংখ্যা শূন্য দশমিক ০১ শতাংশ। এর মধ্যে চিহ্নিত করা সম্ভব হয়েছে ৮ হাজার ৭৬১ জন এইডস রোগী; এদের মধ্যে মারা গেছে ১ হাজার ৫৮৮ জন। সেই হিসেবে দেশে এইডস আক্রান্ত রোগীর আনুমানিক সংখ্যা ১৪ হাজার।
তবে জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা (ইউএনএইচসিআর) এবং বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার দেওয়া প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এইডস রোগীর সংখ্যা সাড়ে ৬ হাজারের বেশি। স্থানীরা জানিয়েছেন, নিজেদের এইডস রোগ আছে জানার পরও তারা কেউ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসছে না। এইডস পরীক্ষার সুযোগ তিনটি সরকারি হাসপাতালে থাকলেও স্বেচ্ছায় যারা আসছেন সে সংখ্যা খুবই কম। এজন্য আক্রান্ত ব্যক্তিদের রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাইরে অবাধ চলাফেরা বন্ধের দাবি জানান স্থানীয়রা।
কক্সবাজারে নিয়োজিত চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, এ জেলায় এইডস রোগীর সংখ্যা দিনদিন বেড়েই চলেছে। প্রতিদিনই এইডস-এ আক্রান্ত তিন-চারজন রোগীর তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। সাধারণ রোগের চিকিৎসায় রক্ত পরীক্ষা করিয়ে অনেকের শরীরে এইডস পাওয়া গেছে। তবে আইনি বাধ্যবাধকতা থাকায় অনেকের রক্ত পরীক্ষা করা যাচ্ছে না। এজন্য আরও বড় পরিসরে এইচআইভি ‘স্ক্যানিং’ বাড়ানোর প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করেন তারা।
কক্সবাজার সদর হাসপাতালের এআরটি অ্যান্ড এইচআইভি ফোকাল পারসন মো. আশিকুর রহমান বলেন, এখনো পুরোটাই সংশ্লিষ্টরা স্ক্যানিংয়ের আওতায় আসেনি। সেজন্য আসলেই ধারণা করা যাচ্ছে না, এখনই সম্পূর্ণভাবে বলা সম্ভব হচ্ছে না যে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ঠিক কি পরিমাণে এইডস সংক্রমিত রোগী রয়েছে। এইচআইভি ‘স্ক্যানিং’ পরিসর আরও বাড়ানো দরকার বলে মনে করেন তিনি।
স্বাস্থ্য সেবা অধিদপ্তরের সংক্রামক রোগনিয়ন্ত্রণ বিভাগের রোগ নিয়ন্ত্রণ ও লাইন পরিচালক প্রফেসর ডা. মো. নাজমুল ইসলাম বলেন, ক্যাম্পে যারা বসবাস করেন তারা যদি সচেতন না হন এবং তারা সচেতনতার জায়গা থেকে পরস্পর পরস্পরকে যদি সহায়তা না করেন তাহলে এটি কিন্তু সরকারের একার পক্ষে নিয়ন্ত্রণে রাখা অত্যন্ত দুঃসাধ্য ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে।
জানা গেছে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এইডস ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম মিয়ানমার। রোহিঙ্গাদের মধ্যে এইডস আক্রান্ত হওয়ার হার বেশি হওয়ায় ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশও। নতুন ও পুরনো মিলে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি আশ্রয় শিবিরে বসবাস করছে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গারা। আর স্থানীয় বাসিন্দা রয়েছে পাঁচ লাখের মতো।
জাতিসংঘের এইডসবিষয়ক প্রতিষ্ঠান ইউএনএইডসের সর্বশেষ তথ্য বলছে, মিয়ানমারে জনসংখ্যা ৫ কোটি ২০ লাখ। এর মধ্যে এইচআইভি নিয়ে বসবাসকারী মানুষ ২ লাখ ৩০ হাজার। আর দেশটির এইচআইভি বহনকারীর সংখ্যা শূন্য দশমিক ৮ শতাংশ। সেই হিসাবেও সাড়ে ছয় হাজার রোহিঙ্গা এইচআইভিতে আক্রান্ত, তা বলা যায়। সূত্র ভোরের ডাক
পাঠকের মতামত: