কক্সবাজার, সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪

রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ‘সন্ত্রাসী কার্যক্রম’ এখন বাইরে আসার শঙ্কা

সাম্প্রতিক সময়ে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে একের পর এক হত্যা, অগ্নিসংযোগ, অপহরণের ঘটনায় ক্যাম্প এলাকা অস্থির হয়ে উঠেছে। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির এক প্রতিবেদন বলছে— আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি বা আরসাসহ তিনটি সন্ত্রাসী গ্রুপ এবং সাতটি ডাকাত দল রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে সক্রিয় রয়েছে। যদিও ক্যাম্প ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের দাবি— তারা নানা গোষ্ঠীর নাম শুনেছেন, কিন্তু তাদের কাজ দৃশ্যমান না। আর ‘কক্সবাজার বাঁচাও আন্দোলন’ বলছে, এ ধরনের ক্যাম্প যত দীর্ঘস্থায়ী হবে, সহিংসতা সন্ত্রাস অস্থিরতা বাড়বে। আর এটা বাইরেও ছড়াবে, এটা আমরা শুরু থেকেই বলে আসছি। মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, এ ধরনের সন্ত্রাসী গ্রুপের সক্রিয়তার কথা শুরু থেকেই শোনা গেছে। এখন এটা অনেক বেশি দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে।

১৬ ফেব্রুয়ারি কক্সবাজারের উখিয়ায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পৃথক ঘটনায় দুষ্কৃতকারীদের গুলিতে এক নারী নিহত ও ক্যাম্পের এক হেড মাঝি গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবর আসে। এদিন সকালে উখিয়া ময়নারঘোনা ক্যাম্প-৮ এবং ক্যাম্প-১২-তে এ ঘটনা ঘটে বলে জানান উখিয়া থানার ওসি শেখ মোহাম্মদ আলী। এদিকে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির এক প্রতিবেদন গত ১৫ ফেব্রুয়ারি উপস্থাপন করা হয়। সেখানে বলা হয়েছে, ২০২১ ও ২০২২ সালে সংঘটিত অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের বিশ্লেষণে দেখা যায়— এ সময়ে বেড়েছে হত্যাকাণ্ড। ২০২১ সালে যেখানে ২২টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে, ২০২২ সালে তা বেড়ে হয় ৩২টি। জানুয়ারি ২০২১ থেকে ডিসেম্বর ২০২২ পর্যন্ত ২২২টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এরমধ্যে ৯৯টি দুর্ঘটনাজনিত। ৬০টি নাশকতামূলক ও ৬৩টির কারণ জানা যায়নি।

আধিপত্য বিস্তারই প্রধান লক্ষ্য

গত ১০ ডিসেম্বর কক্সবাজারের উখিয়া ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের দুই গ্রুপের মধ্যে গোলাগুলি হয়। ওই ঘটনায় দুই রোহিঙ্গা গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান।

এর কিছুদিন পর ২৬ ডিসেম্বর উখিয়ায় সন্ত্রাসীদের ছুরিকাঘাত ও গুলিতে ক্যাম্পের রোহিঙ্গা নেতা বা হেড মাঝি মোহাম্মদ হোসেন (৪০) নিহত হন। এরপর ৬ জানুয়ারি উখিয়ার বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পে গোলাগুলিতে মোহাম্মদ নুরুন্নবী (৪০) নামে এক রোহিঙ্গা গুলিবিদ্ধ হন। পরে তার ঘরে তল্লাশি চালিয়ে গ্রেনেড উদ্ধার করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

এরপর চলতি বছরের ১৮ জানুয়ারি বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুমের তুমব্রু সীমান্তে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বিচ্ছিন্নতাবাদী দুটি সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) ও রোহিঙ্গা সলিডারিটি অরগানাইজেশনের (আরএসও) সদস্যদের মধ্যে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ হয়। কুতুপালং ক্যাম্পের এক বেসরকারি কর্মী বলেন, যা হয় তা আধিপত্যকেন্দ্রিক। আপনি আরসা আরওএসও যে নামেই ডাকেন, এরা প্রত্যাবাসনের বিরোধী। এরা চায় না রোহিঙ্গারা গণতান্ত্রিকভাবে সংগঠিত হোক।

রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ভেতরের চিত্র
কারা অস্থির করে রেখেছে ক্যাম্পগুলো?

বারবারই একটি প্রশ্ন উঠছে, ক্যাম্পের ভেতরে অবস্থানরত মানুষ, নাকি বাইরে থেকে আসা কোনও স্বার্থান্বেষী মহল অস্থিরতা তৈরি করছে। গতকাল (বুধবার,১৬ ফেব্রুয়ারি)) কমিটির কাছে পেশকৃত উপরোল্লিখিত প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে ১০টি দুর্বৃত্ত দল বর্তমানে সক্রিয় রয়েছে। এরমধ্যে আরসা সক্রিয় রয়েছে উখিয়া, বালুখালী, পালংখালী, হোয়াইক্যংয়ে। আরএসও এবং মাস্টার মুন্না দল উখিয়া, পালংখালীতে। ইসলামি মাহাজ ও জাবু ডাকাত দল হোয়াইক্যংয়ে এবং নয়াপাড়া ক্যাম্পে চাকমা ডাকাত দল, নবী হোসেন ডাকাত দল, পুতিয়া ডাকাত দল, সালমান শাহ ডাকাত দল, খালেক ডাকাত দল সক্রিয় বলে উল্লেখ করা হয়।

তবে আরও কিছু কারণেও অস্থিরতা তৈরি হয় উল্লেখ করে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক নূর খান বলেন, ‘একটা নির্দিষ্ট জায়গায় আটকে থাকা জীবন-যাপনের সব উপকরণ না পাওয়া, মানবেতরভাবে বসবাসের কারণে রোহিঙ্গারা এখন আর তাদের সামনে ভালো থাকার মতো কোনও আশার আলো পাচ্ছে না। ফলে এখান থেকে বেরিয়ে ভালো থাকা, জীবনবাজি রেখে হলেও সাগর পাড়ি দিয়ে পালানো, ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে দেশের মধ্যে কাজে ঢোকার চেষ্টা করার মতো বিষয়গুলো ঘটছে। মূল সমস্যা হলো— মহিবুল্লাহর হত্যার পর এই গোষ্ঠীর নেতৃত্ব দেওয়ার মতো কেউ নেই। সেই সুযোগে সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা ব্যাপক তৎপরতার দিকে ঝুঁকে পড়ছে।

প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটিতে উপস্থাপিত প্রতিবেদনে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে ১০টি দুর্বৃত্ত দল বর্তমানে সক্রিয় রয়েছে বলা হয়েছে। এটা কী ধরনের অস্বস্তি তৈরি করতে পারে প্রশ্নে নূর খান বলেন, ‘এই গোষ্ঠীগুলো ক্যাম্প এবং সীমান্ত এলাকায় তৎপর আছে। এদের বসবাস দীর্ঘস্থায়ী হলে, সেটা আমাদের আশেপাশে ছড়াবে। ফলে এখনই যদি সঠিক উদ্যোগ না নেওয়া হয় এবং যদি গণতান্ত্রিক সংগঠন তৈরির পরিবেশ সৃষ্টি না করতে পারি, তাহলে আমাদের শান্তি হুমকির মুখে পড়বে।’

এরকম যে হবে তা আমরা শুরু থেকেই বলে আসছি। কিন্তু কেউ শোনেনি উল্লেখ করে ‘কক্সবাজার বাঁচাও আন্দোলনের’ সভাপতি অ্যাডভোকেট আয়াসুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এরা মাদক চোরাচালানের সঙ্গে এমনভাবে জড়িয়ে গেছে, এক গোষ্ঠী আরেক গোষ্ঠীর চেয়ে বেশি প্রভাবশালী হতে গিয়ে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এখন বেশ কিছুদিন হলো অভিযান চালাচ্ছে, পরিস্থিতি খুবই ভয়াবহ হওয়ার আগে এদের ঠেকানো জরুরি।’

বরাবরই ক্যাম্পে নানা অস্থিরতার কথা গণমাধ্যমে দেখা যায়। কিন্তু গত কয়েকমাসে সেটা বেশ ঘনঘন হচ্ছে, তা আমাদের জন্য শঙ্কার কিনা এবং কতগুলো উগ্রগোষ্ঠী ভেতরে কাজ করছে— জানতে চাইলে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মিজানুর রহমান বলেন, ‘আমি কতগুলোর নাম শুনেছি। যেমন- আরসা, মুন্না গ্রুপ, নবী হোসেন, সালমান শাহ, আরএসও, ইসলামিক মাহাজ— ১২/১৫টা হয়তো। কাউকে কাউকে না চিনেই আমরা আন্দাজের ওপর সংজ্ঞায়িত করি। সেটা আত্মঘাতী হবে।’ তিনি বলেন, ‘আমার মতে, তাদের কোনও আদর্শ নেই, ভূ-রাজনৈতিক জ্ঞান নেই, কেবল আছে ব্যক্তিগত ও গোষ্ঠীগত চাওয়া। তাদের বেশিরভাগ নির্যাতনের সঙ্গে যুক্ত। এরা ফেরত যাবে, সেটা এদের দেখলে মনে হয় না। যেভাবে নিজেদের মানুষদের সঙ্গে যা করছে, মনে হয় না তারা নিজেদের দেশ উদ্ধারের কোনও চিন্তা করে। বলা হয়, তারা কনজারভেটিভ মুসলিম, সেটাও আমার মনে হয় না। কিছু গোড়া মানুষ আছে, যারা এক ধরনের মোল্লাতন্ত্র কায়েম করতে চায়।’

উখিয়া থানার ওসি শেখ মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘ক্যাম্পের ভেতর থেকে অপরাধ বাইরে ছড়িয়ে পড়ার বিষয়ে আমার কাছে কোনও তথ্য নেই। আর ভেতরে নিয়মিত অভিযান চলছে, নিয়ন্ত্রণে আছে।’ সূত্র বাংলা ট্রিবিউন

পাঠকের মতামত: